মহাকাশে যত কাজের কাজি ‘বঙ্গবন্ধু-১’
১১ মে ২০১৮ ০১:০৪
।। সন্দীপন বসু।।
স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ শব্দটা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেল, ইন্টারনেট, তথ্য আদান-প্রদানের আধুনিক ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন রকমের ছবি। বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের মতো তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করলেও নিজস্ব স্যাটেলাইট ব্যবস্থা ছিল না। এতদিন ধরে আমরা অন্য দেশের স্যাটেলাইট ভাড়া করে এ প্রয়োজনগুলো মেটাতাম।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে গেলে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার পরে চতুর্থ দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সময় আজ রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের কেপ ক্যানাভেরাল থেকে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করা হবে। এটি ১১৯ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমায় নির্ধারিত স্লটে পৌঁছতে আট দিন সময় নেবে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন-৯’ রকেটে করেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে পাঠানো হবে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ জানান, বঙ্গবন্ধু-১ এর মাধ্যমে নিজস্ব স্যাটেলাইটের অধিকারী বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসাবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটবে। এছাড়া এই স্যাটেলাইট স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের যেমন নির্ভরতা কমবে অন্য দেশের ওপর, তেমনি দেশের অভ্যন্তরীণ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মত, মহাকাশে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করব। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষ নিজস্ব স্যাটেলাইট ব্যবস্থায় মুহূর্তের মধ্যেই সারা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে।
যোগাযোগ উপগ্রহ হচ্ছে পৃথিবীকে ঘিরে রকেটের মাধ্যমে কক্ষপথের যথাযথ স্থানে স্থাপিত মহাশূন্যযান যা বেতার সংকেত গ্রহণ ও প্রেরণ করে। স্যাটেলাইট বা যোগাযোগ উপগ্রহ এ-সমস্ত সংকেতকে বিবর্ধিত ও বাছাই করে এমনকি এর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এর কাজের পরিধি ও বিস্তৃতি আরও ব্যাপক। একটি ভূ-পৃষ্ঠস্থ রিপিটর যেখানে দুটো স্থির অবস্থানের মধ্যে যোগাযোগ সংকেত সম্প্রচার ‘রিলে’ করে সেখানে একটি যোগাযোগ উপগ্রহ বিস্তৃত এলাকাব্যাপী স্থির ও ভ্রাম্যমাণ উভয় প্রকারের অবস্থানের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
প্রকারভেদে বিভিন্ন স্যাটেলাইট বিভিন্ন ধরনের কাজ করে থাকে। কিছু স্যাটেলাইট বিভিন্ন গ্রহের ছবি সংগ্রহ করে, কোনোটা আবহাওয়াবিদদের আবহাওয়ার পূর্বাভাসসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আভাস দিতেও সাহায্য করে। আবার কিছু স্যাটেলাইট অন্যান্য গ্রহ, সূর্য, কৃষ্ণবিবর বা দূরবর্তী ছায়াপথের ছবি নিতে কক্ষপথে ঘুরছে। এছাড়াও এমন কিছু উপগ্রহ রয়েছে যা মূলত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়; যেমন টিভি সিগন্যাল, বিশ্বজুড়ে ফোন কলের সংযোগ স্থাপন ইত্যাদি। অনেক স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয় জিপিএস সিস্টেমের কাজে। স্যাটেলাইটের সাহায্যে ভয়েস, টেক্সট, ইমেজ এবং ভিডিও পাঠানোর কাজও করে কৃত্তিম উপগ্রহ।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থার (নাসা) ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, সারাবিশ্বে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, আবহাওয়া ও জলবায়ু পর্যবেক্ষণ, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের (জিপিএস) অবস্থান নির্ণয়, গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড, জরিপ ও সেনাসংশ্লিষ্ট কাজে উপগ্রহ বেশি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া মহাকাশ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, টেলিভিশন বা রেডিও চ্যানেলের সম্প্রচার কাজ, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট যোগাযোগ প্রযুক্তি, আকাশ-সড়ক ও জলপথে দিক নির্ণয় ও নির্দেশনায়, দূর সংবেদনশীল অনুসন্ধান, মাটি বা পানির নিচে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজে, মহাশূন্যে উদ্ভাবন ও আবিষ্কার, ছবি তোলা ও তথ্যসংগ্রহ, বন্যা-ঝড়সহ প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনা ও বিপর্যয়ের পূর্বাভাসে উপগ্রহের সাহায্য নেওয়া হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন রশ্মি শনাক্তকরণ, দুর্গম অঞ্চলে উদ্ধারকাজে সহায়তা, তেল-গ্যাসসহ বিভিন্ন খনি শনাক্তকরণ ইত্যাদি কাজেও কৃত্রিম উপগ্রহের ভূমিকা আছে।
তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পাওয়া সেবাগুলোর এত বিস্তৃত ক্ষেত্রের কথা এখনই ভাবা হচ্ছে না। এ দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে মূল বাধা দূরে সবচেয়ে কার্যকরী হবে স্যাটেলাইটি। বর্তমানে আমাদের দেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অন্য দেশের স্যাটেলাইট থেকে কানেকটিভিটি কিনছে। চ্যানেলগুলো এই সেবা পাবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে। টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়াও ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ভি-স্যাট ও বেতারসহ ৪০ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে। বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির জন্য রাখা হবে। স্যাটেলাইটের কার্যক্রম পুরোপুরিভাবে শুরু হলে আশপাশের কয়েকটি দেশে টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচার সেবা দেওয়ার জন্য জিয়োসিক্রোনাস স্যাটেলাইট সিস্টেম এর গ্রাউন্ড সিস্টেমসহ সব ধরনের সেবা পাওয়া যাবে।
এছাড়া দুর্গম অঞ্চলে সাশ্রয়ী যোগাযোগে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর তাৎক্ষণিক সেবায় ভূমিকা রাখবে। দুর্যোগে অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দেশে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পরিবেশ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ই-সেবা নিশ্চিত করবে ।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কৃত্তিম উপগ্রহের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এই সময়ে মোবাইল ও রেডিও যোগাযোগের বেশিরভাগই উপগ্রহের মাধ্যমেই হচ্ছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে নির্ভুল জিপিএস সিস্টেমের সেবা এই কৃত্তিম উপগ্রহের মাধ্যমে পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সারাবাংলা/ এসবি