আ.লীগে ফের জাফর-নিক্সন দ্বৈরথ, বিএনপিতে এগিয়ে ইকবাল
২৮ জুন ২০২৩ ০৮:০০
ঢাকা: নৌকার দুর্গ হিসেবে পরিচিত ফরিদপুর-৪ আসন। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের লড়াই হবে বলে মনে করছে স্থানীয়রা। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পরপর দুই বার বিজয়ী যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা বর্তমান সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী এ আসনটিতে নিজের অবস্থান পাকা করে নিয়েছেন। এবার দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করার ব্যাপার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তিনি। শেষ পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন না পেলে বিগত দু’টি নির্বাচনের মতো এবারও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়বেন নিক্সন।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহও ছেড়ে কথা বলছেন না। তিনিও দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। গত দু’টি নির্বাচনে নিজ দলের তরুণ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হলেও হাল ছাড়ছেন না তিনি। দলের ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচিগুলোতে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার ব্যাপারে নিজের আগ্রহের কথা বলে আসছেন বারবার। দলীয় মনোনয়ন পাবার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী কাজী জাফর উল্লাহও।
এ আসনের লড়াইটা যখন আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের তখন বিএনপিকে কেউ ভোটের হিসাবে রাখছে না। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে ভোটের হিসাব পাল্টে যেতে পারে বলে মনে করছে স্থানীয় ভোটার ও সাধারণ জনগণ। তারা বলছেন, এ আসনটি নৌকার ঘাঁটি হলেও টানা ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বিএনপির প্রতি ‘মোহ’ জন্মেছে। এ কারণে বিএনপি নির্বাচনে এলে বদলে যেতে পারে হিসাব-নিকাশ। সেক্ষেত্রে লড়াই হবে ত্রি-মুখী।
ফরিদপুর-৪ আসনটি ভাঙ্গা, চরভদ্রাসন এবং সদরপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত। এটি জাতীয় সংসদের ২১৪ নম্বর আসন। এই আসনটিকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলা যেতে পারে। স্বাধীনতার পর এই আসনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ১৯৭৩ সালে এই এখান থেকে জয় পান আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুস সালাম মিয়া। এরপর ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে পর পর দুটি নির্বাচনে জয় পান অ্যাডভোকেট মো. মোশাররফ হোসেন। আর ২০০১ এ অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হন অ্যাডভোকেট মো. আবদুর রাজ্জাক। ওয়ান ইলেভেনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ফরিদপুর-৪ আসনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হন কাজী জাফর উল্লাহর স্ত্রী নিলুফার জাফর উল্লাহ।
এরপর, ২০১৪ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পান কাজী জাফর উল্লাহ। ওই নির্বাচনেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হন নিক্সন চৌধুরী। নির্বাচনি যুদ্ধে অভিষেকেই বাজিমাৎ করেন তিনি। অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ জাফর উল্লাহকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নিক্সন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ফের জাফর উল্লাহকে হারিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন মুজিবুর রহমান নিক্সন।
নির্বাচনি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফরিদপুর-৪ আসন জুড়ে কাজী জাফর উল্লাহ ও মুজিবুর রহমান নিক্সনের সমর্থকগোষ্ঠী প্রচার-প্রচারণায় সরব। দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে মাঠে নেমে পড়েছেন তারা। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরাও দলীয় কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে নির্বাচনি মহড়া সেরে নিচ্ছেন। দলটির নেতা-কর্মী, সমর্থকরা আন্দোলন এবং নির্বাচন— দু’টি বিষয়কে সামনে রেখে এগোচ্ছেন।
আরও পড়ুন:
আওয়ামী লীগ
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে এ আসনটিতে কাজী জাফর উল্লাহ নৌকার অন্যতম দাবিদার। নৌকা প্রতীক নিয়ে দুই-দুইবার পরাজিত হলেও তিনি আওয়ামী লীগের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা, গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক এবং দলে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা রয়েছে। তিনি শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত নেতাদের মধ্যে অন্যতম। অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব শেখ হাসিনা কাজী জাফর উল্লাহ’র হাতেই অর্পণ করেন এবং তাকে বিশ্বাস করেন। শেখ হাসিনার প্রশ্নে তিনি কখনও আপস করেননি। সবসময় দলীয় প্রধানের আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন কাজী জাফর উল্লাহ।
অবশ্য নির্বাচনি এলাকার সাধারণ ভোটার, দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা বলছেন, রাজনীতিতে বিশ্বস্ততা একটি বড় যোগ্যতা। রাজনীতি করতে গেলে গণমানুষের কাছাকাছি যেমন থাকতে হয়, থাকতে হয় কর্মীদের সঙ্গেও, হতে হয় কর্মীবান্ধব। সেদিক দিয়ে কাজী জাফর উল্লাহ অনেক পিছিয়ে। তার জনসম্পৃক্ততা যে খুব একটা ভালো নয়, তা বোঝা গেছে গত দু’টি নির্বাচনে। তিনি গত দুই নির্বাচনেই স্বতন্ত্র প্রার্থী নিক্সন চৌধুরীর কাছে পরাজিত হয়েছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, ফরিদপুর-৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী ফরিদপুরের বাসিন্দা না হয়েও মাদারীপুর থেকে এসে নৌকার হেভিওয়েট প্রার্থী কাজী জাফর উল্লাহকে হারিয়ে নিজের সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। তার এই বিপুল জনপ্রিয়তা ও প্রভাব কোনো মিরাকল নয়। তিনিও আওয়ামী পরিবারেরই লোক। নিক্সন চৌধুরীর বাবা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরীর ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নি জামাই। সেদিক থেকে নিক্সন চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র, শেখ হাসিনার ভাগ্নে। নিক্সন চৌধুরীর আরেকটি পরিচয় হল, তিনি জেপি’র চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু’র জামাতা।
বিগত দুইটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী কাজী জাফর উল্লাহকে যখন হারিয়ে দেন মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী, তখন দলীয় কোনো পদ ছিল না তার। বর্তমানে তিনি আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। সম্প্রতি নির্বাচনি এলাকার সভা-সমাবেশ, ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি, প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা, জনসংযোগ ও সেবামূলক কর্মকাণ্ডে তার পেছনে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। বলতে গেলে, স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি এখন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। মাঠের রাজনীতিতে জাফর উল্লাহ চৌধুরীকে অনেকটাই পেছনে ফেলে দিয়েছেন নিক্সন চৌধুরী। এবার আওয়ামী লীগ থেকেই মনোনয়ন চাইবেন তিনি।
জানতে চাইলে মুজিবুর রহমান নিক্সন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি নেতা নই, কর্মী। আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর পাশে আছি। নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে আছি সাধারণ জনগণের পাশে। আশা করছি নেত্রী (শেখ হাসিনা) এবার আমার কাজের মূল্যায়ন করবেন। আমি নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে চাই এবং নির্বাচনে জয়ী হয়ে এ আসনে আওয়ামী লীগের অবস্থান আরও মজবুত করতে চাই।’
বিএনপি
নির্বাচনের ব্যাপারে কেন্দ্র থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না এলেও বিএনপি থেকে এ আসনে মনোনয়ন পেতে মাঠে কাজ করছেন ভাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার ইকবাল হোসেন সেলিম ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক আলমগীর কবির। জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি শাহরিয়া ইসলাম শায়লাও আছেন মনোনয়ন দৌড়ে।
তবে এ তিন জনের মধ্যে খন্দকার ইকবাল হোসেন সেলিমের দিকেই বিএনপির মনোনয়ন পাল্লা ঝুলে আছে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। সদরপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম রব্বানী, চরভদ্রাসন উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোতাজ্জেল মৃধা, সদরপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মোকলেচুর রহমান, ভাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা কামাল হাসান, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান মুনশি, সাংগঠনিক সম্পাদক আইয়ুব মোল্লা, সদরপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী বদরুজ্জামান, চরভদ্রাসন উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুসের মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বিএনপির প্রার্থী হিসেবে খন্দকার ইকবাল হোসেন সেলিমকেই চাচ্ছেন।
বিএনপির নেতা-কর্মী সমর্থকরা বলছেন, দলের দুর্দিনে সেলিম খন্দকার নেতা-কর্মীদের পাশে ছিলেন। তিনি আন্দোলন, সংগ্রাম করতে গিয়ে মামলার আসামি হয়েছেন। নদী ভাঙন ও বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন সেলিম। এলাকায় বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুদান, সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে ওঠা-বসা ও সুসম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে খন্দকার সেলিম বিএনপির অন্যসব আগ্রহী প্রার্থীর চেয়ে মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন, যেটা শাহরিয়া ইসলাম শায়লা বা আলমগীর কবীরের মধ্যে নেই। সুতরাং গত বছরের ন্যায় এবারও দলীয় মনোনয়ন খন্দকার ইকবাল হোসেন সেলিমই পাচ্ছেন— এমনটাই মনে করছে তার অনুসারীরা।
ফরিদপুর-৪ আসনে কে হচ্ছেন বিএনপির প্রার্থী? জানতে চাইলে ফরিদপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মোদাররেছ আলী ইছা সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রত্যেকটা আসনে আমাদের একাধিক যোগ্য প্রার্থী আছেন। এদের মধ্য থেকেই দল একজনকে বেছে নেবে। তবে আমরা এই মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না। আমরা ভাবছি এই সরকারের পতন নিয়ে। সরকারের পতন নিশ্চিত করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানই আমাদের আপাতত লক্ষ্য।’
ভাঙ্গার বাসিন্দা এবং সাংস্কৃতিক কর্মী নাজমুল ইসলাম সবুজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় গত দুইটা নির্বাচনে মূলত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের লড়াই হয়েছে। এবার অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে মনোনয়ন নিক্সনই পাবেন। আবার দলের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে কাজী জাফর উল্লাহও পেতে পারেন। তবে বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে, তাহলে নিক্সন অথবা কাজী জাফর উল্লাহ’র মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে আওয়ামী লীগকে। এক আসনে আওয়ামী লীগের দুইজন প্রার্থী থাকলে সুবিধা নেবে বিএনপি। আর যদি বিএনপি নির্বাচনে না আসে, তাহলে নিক্সন ও জাফর উল্লাহ— দু’জনের মধ্যে মূল লড়াইটা হবে; গত দুই নির্বাচনে যেমনটা হয়েছে।’
উল্লেখ্য, সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী এই আসেনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৭০ হাজার ৬৬৬। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ১ লাখ ৪৫ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগ নেতা মুজিবুর রহমান নিক্সন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ মনোনীত কাজী জাফর উল্লাহ পান ৯৫ হাজার ৩৬৩ ভোট। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও এই আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয় হন মুজিবুর রহমান নিক্সন। তিনি ৯৮ হাজার ৩০০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের কাজী জাফর উল্লাহ পান ৭২ হাজার ২৪৮ ভোট। আর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৪৯১টি ভোট পেয়ে জয়ী হন কাজী জাফর উল্লাহর স্ত্রী নিলুফার জাফর উল্লাহ। সেবার তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাকের পার্টির মোস্তফা আমির ফয়সাল গোলাপ ফুল প্রতীকে পান ৭০ হাজার ১৫৫ ভোট।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম
কাজী জাফর উল্লাহ খন্দকার ইকবাল হোসেন সেলিম দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা-সদরপুর-চরভদ্রাসন) মুজিবুর রহমান নিক্সন