Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বছরের প্রথম ৬ মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর রেকর্ড

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৭ জুন ২০২৩ ২০:৩৮

ঢাকা: বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় এবার ভয়াবহ হতে যাচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। চলতি বছরের ২৬ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে ৪৫ জন। এই সময়ের মাঝে হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে চিকিৎসা নিয়েছেন সাত হাজার ৬০৯ জন। ২০০০ সালে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর থেকে প্রথম ছয় মাসে এত মৃত্যু কখনও দেখেনি বাংলাদেশ। শুধুমাত্র জুন মাসের ২৬ দিনেই মারা গেছে ৩২ জন। এর আগে কোনো বছরের প্রথম ছয় মাসে এত বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীও দেখা যায়নি বাংলাদেশে।

বিজ্ঞাপন

শুধুমাত্র ঢাকাতেই নয়, দেশের অন্যান্য স্থানেও এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি অন্য সময়ের তুলনায় খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীও।

এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরইমধ্যে যে পরিস্থিতি তা ভয়াবহ। তার ওপর আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটিতে বাড়ি ফেরার কারণে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। সব মিলিয়ে আশঙ্কা অনুযায়ী ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের বছরগুলোর তুলনায় মারাত্মক হতে পারে। আর তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জোর প্রস্তুতি নিতে হবে।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি কী?

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, ২৬ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে সাত হাজার ৬০৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মাঝে ঢাকা মহানগরীর ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৮৫৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।

ঢাকা মহানগরীর বাইরে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন এক হাজার ৭৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী।

এ ছাড়া ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলা শহরগুলোতে ২৯১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ৭৩৬ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মাঝে মারা গেছেন ৯ জন। ময়মনসিংহ বিভাগে এখন পর্যন্ত ১০৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও কেউ মারা যায়নি। খুলনা বিভাগে এখন পর্যন্ত ১৩৩ জন বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

এছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৩০ জন, রংপুর বিভাগে ২৭ জন ও সিলেট বিভাগে ৩৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে এ সব বিভাগে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুম।

বিজ্ঞাপন

বরিশাল বিভাগে ৩৯৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। এর মাঝে একজন মারা গেছেন।

ছয় মাসেই ছাড়িয়েছে অতীতের রেকর্ড

চলতি বছর জানুয়ারি মাস থেকেই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। শুধু আক্রান্তই না, চলতি বছরের ২৬ জুন পর্যন্ত এরইমধ্যে মারা গেছেন ৪৫ জন। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু সংক্রমণ শনাক্তের পরে প্রথম ছয় মাসে এত মৃত্যু কখনও দেখা যায়নি।

শুধুমাত্র ঢাকাতেই নয় বরং দেশের অন্যান্য স্থানেও চলতি বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে চিকিৎসা নিতে। ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে এরইমধ্যে ১০ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

২৬ জুন পর্যন্ত দেশে সাত হাজার ৬০৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্তের তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। ২০০০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার পরে প্রথম ছয় মাসে এটিই সর্বোচ্চ শনাক্তের তথ্য।

২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল এক হাজার ১১১ জন। বছরটির জুন মাসে প্রথম ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তবে বছর শেষে ২৮১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এটি এক বছরে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ মৃত্যুর পরিসংখ্যান।

২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১০০ জন। তবে এই পাঁচ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যাননি।

২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল দুই হাজার ২০৮ জন। তবে এই ছয় মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সাত জন মারা যাওয়ার তথ্য জানানো হয় সরকারিভাবে।

সাধারণত বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ শুরু হয়ে থাকে জুন-জুলাই মাসের দিকে। কারণ, এ সময়টিতে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানিতে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। অক্টোবর মাস থেকে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ কমতে থাকে বলেও ধারণা করা হতো ২০২২ সালের আগ পর্যন্ত।

কিন্তু ২০২২ সালের নভেম্বরেও দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৯ হাজার ৩৩৪ জন রোগী। এ মাসে ১১৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান যা এক মাসে সর্বোচ্চ মৃত্যুর পরিসংখ্যান।

আর তাই চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই ডেঙ্গুর ঝুঁকি

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ঢাকাকেন্দ্রিক এ ধরনের জরিপ দিয়ে সার্বিক ভবিষ্যদ্বাণী করা ঠিক হবে না। কারণ পুরো বাংলাদেশেই এখন ডেঙ্গুর হটস্পট। তাই শুধু ঢাকা শহর নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই।

তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে মারা যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। সামনে যেহেতু বৃষ্টি হবে, তাই আগেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখা জরুরি।’

অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, ‘এরইমধ্যে পরীক্ষাসহ ডেঙ্গু চিকিৎসায় আমরা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন করে দিয়েছি। গাইডলাইন অনুযায়ীই সবাইকে চিকিৎসা দিতে হবে। প্লেটলেট ব্যবহার নিয়েও গাইডলাইনে নির্দেশনা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগ স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি বেড়ে গেলে করণীয় কী হবে, প্রতিটি হাসপাতালকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। রোগী বাড়লে অতিরিক্ত আবাসিক চিকিৎসক এবং মেডিসিন বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দিতে হবে, যেন ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা ব্যাহত না হয়।’

হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত মশারির ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট পরিচালকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান ডা. আহমেদুল কবীর।

ডেঙ্গুর কোন ধরনের আক্রান্ত রোগী বাড়ছে?

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বছর ডেঙ্গুর ধরন (ভেরিয়েন্ট) ডেন-২-এ বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। সীমিতসংখ্যক নমুনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ রোগী ডেঙ্গুর ধরন ডেন-২-এ আক্রান্ত হয়েছেন। বাকি ৩৮ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন অন্য ধরন ডেন-৩-এ। আইইডিসিআর ডেঙ্গুর ধরন সম্পর্কে এ তথ্য জানিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকে আইইডিসিআর ডেঙ্গুর সেল পর্যবেক্ষণ করছে। এ পর্যন্ত ভাইরাসের চারটি ধরন পাওয়া গেছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত আমাদের সার্কুলেশনে স্ট্রেইন-১ ও ২ ছিল। ২০২১ সালে স্ট্রেইন ৩-এর প্রকোপ দেখা দেয়। কিন্তু ২০২২ সালে স্ট্রেইন ৪-এর উপস্থিতি মিলেছে। এবার ঢাকায় ডেন-ফোরের উপস্থিত পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে কক্সবাজারে ডেন-ওয়ান, ডেন-থ্রি ও ডেন-ফোর সেরোটাইপ ডেঙ্গু হচ্ছে। একাধিক সেরোটাইপে সংক্রমণ ঘটায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি হয় ২০২২ সালে। তবে আমরা এ বছরের পরিস্থিতি এখনো পর্যবেক্ষণ করছি।’

মৃতদের অধিকাংশই শক সিনড্রোমে

১০ জুন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. খুরশিদ আলম জানান, চলতি বছর এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের প্রায় প্রত্যেকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছিলেন এবং শক সিন্ড্রোমে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা ক্লিনিক্যালি তাদের মৃত্যুর কারণ জানান চেষ্টা করেছি। আমাদের কাছে থাকা তথ্যনুযায়ী এখন পর্যন্ত মৃতদের প্রায় প্রত্যেকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছিলেন এবং শক সিন্ড্রোমে তাদের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও অন্য কারণ থাকতে পারে। যা জানার জন্য ময়নাতদন্ত প্রয়োজন। কিন্তু তা পরিবার অনুমোদন দেবে না। আর এটা সাধারণ প্র্যাকটিসও নয়।’

পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?

কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘অন্যান্যবারের তুলনায় এবার জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত রোগীর যে সংখ্যা দেখা গেছে তা উদ্বেগজনক। এই সময়ে ১২ জন মারা গেছে যা অবশ্যই অপূরণীয় ক্ষতি। অথচ এখন পর্যন্ত কিন্তু বৃষ্টি তেমনভাবে শুরু হয় নি। আর তাই সামনের দিনগুলোতে সবাই সতর্ক না হলে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘হটস্পট ব্যবস্থায় ব্যর্থ হওয়ার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগী যেসব এলাকা থেকে বেশি আসে, সেখানে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। দরকার হলে সেখানে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। তা হলে এক রোগী থেকে অন্য রোগী আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। যদি এমনটা না হয় তবে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার সব জায়গায় ডেঙ্গু রোগীর হার সমান নয়। যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি, সেখানে মশক নিধনের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। মাইকিং, জনসচেতনতা, ওষুধ ছিটানো— সবকিছু একসঙ্গে করতে হবে। এমনটা না করতে পারায় এখন পর্যন্ত জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু।’

অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমরা একটা জরিপ করে দেখেছি যে, এদেশের মানুষ এডিস মশা কীভাবে হয়, প্রজননস্থল, বদ্ধ, স্বচ্ছ পানি- এই সবকিছুই জানে। তারপরও তারা সচেতন হন না। এটি একটা মানসিকতা। এর পরিবর্তন দরকার। আর সিটি করপোরেশন যতই বলুক তারা মশার উৎস ধ্বংস করছে। কিন্তু উড়ন্ত এডিস মশা থেকে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এখন কিন্তু ডেঙ্গু শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি প্রায় সারা দেশেই ছড়িয়েছে। আর তাই সারা দেশেই স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করার জন্য। নতুবা পরিস্থিতি আসলে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। এখন থেকেই আমাদের মশার প্রজনন ঠেকাতে হবে। মশার প্রজনন যদি আমার মৌসুমের শুরুতেই ঠেকাতে পারি, তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। বাসা বাড়ি বা আশপাশে যেন পানি জমা না থাকে, পানি জমার মতো কোনো পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়, কোথাও যেন পরিত্যক্ত টায়ার বা কোনো ধরনের পাত্র পড়ে না থাকে, এই বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’

ধ্বংস করতে হবে মশার প্রজননক্ষেত্র

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, ডেঙ্গু যখন কোনো কমিউনিটিতে প্রবেশ করে, তখন তাকে একেবারে নির্মূল করা যায় না। যেহেতু সামনে আরও নগরায়ণ হবে, আরো উন্নয়ন হবে, আমাদের আগেভাগে মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।’

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু যে দেশে ঢোকে, সেখান থেকে বের হয় না। কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের দেশে দুই যুগের বেশি সময় ধরে এর নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ করা হয়নি। ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলেও এর নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। আর তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি একটি সঠিক কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে।’

ডেঙ্গু সংক্রমণ বিষয়ে সতর্ক করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘বাংলাদেশে কিছু দিন ধরে ফের ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রভাব বাড়ছে। এই সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে হলে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।’

জাহিদ মালেক বলেন, ‘সবাইকে নজর রাখতে হবে যে, বাসাবাড়ির ছাদ ও আঙিনায় যেন পানি জমে না থাকে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশার কামড় থেকে মুক্ত থাকতে হবে। আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।’

এডিস মশা নিধনসহ ডেঙ্গু প্রতিরোধে ১১ সুপারিশ

চলতি বছরের প্রথমভাগেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা এখন পর্যন্ত অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। এমন অবস্থায় এ বছর ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণের শঙ্কা প্রকাশ করে দেশবাসীকে সতর্ক করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

প্রতিষ্ঠানটি বলছে, আগাম বৃষ্টি শুরু হওয়ায় এ মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা বেশি। সেদিক থেকে প্রাক-মৌসুমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। সিটি করপোরেশনকে এ বিষয়ে আরও বেশি তৎপর হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

এছাড়াও আসন্ন ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ১১ দফা সুপারিশ করেছে।

নির্দেশনাগুলো হলো:

১. সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগ স্ক্রিনিংয়ের পর্যাপ্ত কিটের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ডেঙ্গু স্ক্রিনিংয়ের চার্জ ১০০ টাকার বেশি হওয়া যাবে না।

২. ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি বেড়ে গেলে আবাসিক চিকিৎসক ও আরএমও এর কক্ষে অতিরিক্ত মেডিসিন বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দিতে হবে। যাতে আগত ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যাহত না হয়।

৩. হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত মশারির ব্যবস্থা করার জন্য সংশ্লিষ্ট পরিচালককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

৪. কোনো ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য প্লাটলেট প্রয়োজন হলে জাতীয় গাইড লাইন অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। সপ্তাহের সাতদিনই ২৪ ঘণ্টা ল্যাব খোলা রাখতে হবে। সরকারিভাবে ২১টি সেন্টারে প্লাটিলেট সরবরাহের ব্যবস্থা আছে, কোনো রোগীর প্লাটিলেট প্রয়োজন হলে উল্লেখিত ২১টি সেন্টার থেকে সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

এ সব সেন্টারের মধ্যে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ, বাংলাদেশ (এনআইসিভিডি), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজ অ্যান্ড ইউরোলজি (নিকডো), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতাল (নিনস), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চ অ্যান্ড হাসপাতাল (এনআইসিআরএইচ), রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ জিয়াউর রহামান মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতল, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধী ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিডফোর্ট হাসপাতল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর, শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিরাজগঞ্জ।

৫. ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার সহযোগিতায় হাসপাতালের চারপাশ নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। হাসপাতাল কম্পাউন্ডে ডাব বিক্রি বন্ধ করতে হবে। হাসপাতালের অভ্যন্তরে নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।

৬. ডেঙ্গু একটি ভেক্টর বাহিত রোগ বিধায় জিও লোকেশন ট্রেসিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মোবাইল নং এবং পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা অবশ্যই সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণ করতে হবে।

৭. আইইডিসিআর এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার যৌথ উদ্যোগে কন্ট্রোল রুম খুলতে হবে।

৮. আগ্রহী চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখায় যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

৯. এডিস মশার লার্ভা নিধনে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অতিদ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

১০. বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহে ডেঙ্গু শনাক্তকরণের এনএস১ অ্যান্টিজেন (সর্বোচ্চ ৫০০টাকা), আইজিজি এবং আইজিএম (সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা), সিবিসি (সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা) পরীক্ষা সরকারের পূর্ব নির্ধারিত মূল্যে করতে হবে।

১১. বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা জাতীয় গাইড লাইন অনুযায়ী করতে হবে এবং প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীর তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস শাখাকে অবহিত করতে হবে।

সারাবাংলা/এসবি/একে

এডিস মশা ডেঙ্গু ঢাকা সিটি করপোরেশন মশা নিধন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর