Thursday 31 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘খামারের ব্যবসা আর করব না, চট্টগ্রামেও আসব না’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৮ জুন ২০২৩ ১৯:৪২

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের সাগরিকা গরুর বাজার। কুষ্টিয়া থেকে পাঁচ দিন আগে এই বাজারে ১১টি গরু নিয়ে এসেছিলেন প্রান্তিক ব্যাপারী রাশেদুজ্জামান রাশেদ। কোরবানির আগের দিন অর্থাৎ, বাজারের শেষদিন পর্যন্ত একটি গরুও বিক্রি হয়নি তার। সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এই ব্যাপারী বলেন, ‘তওবা করছি, খামারের ব্যবসা আর করব না, চিরতরে বিদায় নিলাম। আর কোনোদিন চট্টগ্রামে গরু নিয়ে আসব না।’

বিজ্ঞাপন

বুধবার (২৮ জুন) দুপুরে সাগরিকা গরুর বাজারে দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আসা প্রান্তিক ব্যাপারীদের অনেকের মধ্যেই এমন হতাশা দেখা গেছে। চট্টগ্রামের স্থানীয় ব্যাপারী এবং খামারা মালিকদের বিক্রি ভালো হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।

তবে প্রান্তিক ব্যাপারীরা জানিয়েছেন, এক লাখ টাকার নিচে এবং দেড় লাখ টাকার মধ্যে গরুর বিক্রি ভালো হয়েছে। কিন্তু দূরদূরান্ত থেকে ব্যাপারীরা যেসব গরু এনেছেন সেগুলোর প্রায় সবগুলোর দাম তিন লাখের কাছাকাছি। বাজারে বেশি দামের গরু বিক্রি এবার সন্তোষজনক হয়নি। বেশি দামের গরু বড় বড় খামার থেকেই কিনেছেন কোরবানি দাতারা।

অন্যদিকে বাজারের শেষদিনে এসে ক্রেতারা বলছেন, বিক্রেতারা কোনোভাবেই গরুর দাম কমাচ্ছেন না। গরুর দামও এবার আগের তুলনায় ২-৩ গুণ বেশি।

বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) ঈদুল আজহা উদযাপন হবে। কোরবানির পশু বিক্রির জন্য এবার নগরীতে সাতটি অস্থায়ী ও তিনটি স্থায়ী হাট বসেছে। স্থায়ী পশুর হাট হচ্ছে- সাগরিকা বাজার, বিবিরহাট বাজার ও পোস্তারপাড় ছাগলের হাট।

সাতটি অস্থায়ী পশুর হাটের মধ্যে আছে—কর্ণফুলী অস্থায়ী পশু বাজার, ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের বাটারফ্লাই পার্কের দক্ষিণে টি কে গ্রুপের খালি মাঠ, ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের হোসেন আহম্মদপাড়া-সংলগ্ন টিএসপি মাঠ, ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের মুসলিমাবাদ রোডের সিআইপি জসিমের খালি মাঠ, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের বড় পোলের গোডাউনের মাঠ, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়াজেদিয়া মোড়, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের আউটার রিং রোডের সিডিএ মাটির মাঠ।

কুমিল্লা থেকে পাঁচটি গরু নিয়ে সাগরিকা বাজারে আসা ব্যাপারী সাদ্দাম হোসেন জানান, তার পাঁচটি গরুর মধ্যে চারটি বিক্রি হয়েছে শেষদিনে। দেড় লাখ টাকা করে দুটি, অন্য একটি ২ লাখ ৮০ হাজার এবং আরেকটি ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিক্রিতে খুশি সাদ্দাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘যারা ছোটবড় মিলিয়ে গরু এনেছে, তারা বিক্রি করতে পারছে। যারা সবগুলো বড় গরু নিয়ে এসেছে, তারা পারছে না।’

সাগরিকা গরুর বাজারে বুধবার সকাল থেকে মানুষের আনাগোনা কম দেখা গেছে। বেলা গড়াতে কিছুটা বাড়লেও তা উল্লেখযোগ্য নয় বলে জানান ব্যাপারীরা।

কুষ্টিয়া থেকে আসা মো. রাশেদ নামে আরেক ব্যাপারী জানালেন, তার ছয়টি গরুর মধ্যে একটিও বিক্রি হয়নি। গরুগুলোর দাম তিন থেকে সাড়ে তিন লাখের মধ্যে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ দেড় লাখের ওপরে দরদাম করেনি।

রাশেদ বলেন, আমরা স্বীকার করছি, গরুর দাম এবার বেশি। কী করব, যে ভুষি ১৬০০ টাকায় কিনতাম, সেটা এখন সাড়ে তিন হাজার টাকা। ছোলা, ভুট্টা, কাঁচাঘাস-সবকিছুই তো কিনতে হচ্ছে। পরিশ্রমের কথা বাদ দিলাম, খাদ্যের দাম তো বেশি। তিন লাখ টাকার গরু দেড় লাখ টাকায় কিভাবে বিক্রি করব, উপরওয়ালা জানে।

কুষ্টিয়ার প্রান্তিক ব্যাপারী রাশেদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, গত ১০ বছরে এমন মাইর (লোকসান) আর খাইনি। আমি পড়ালেখা করেছি। এগ্রো ফার্মে চাকরি করতাম। কপাল খারাপ, টাকাপয়সা ইনভেস্ট করে গরু পালতে গেছিলাম। হাটে মানুষ নাই, গরু কেউ কিনছে না। যেগুলা আনছি, ফেরত নিয়ে যেতে হবে। এমন মাইর খাব ভাবিনাই। আমরা হতাশ, খুব হতাশ।

 

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে প্রান্তিক কৃষক জসিম উদ্দিন দুটি গরু নিয়ে সাগরিকা বাজারে এসেছেন বুধবার। এক লাখ ৫৬ হাজার ও এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা- গরু দুটোর দাম ধরেছেন তিনি। ঘরে পোষা গরু দুটি কিনতে অবশ্য ক্রেতার অভাব নেই। কেউ ধরে দেখছেন, কেউ দরদাম করছেন। তবে জসিমের ‘এক দাম’।

জসিম ‍উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, রাতের খাদ্য, দিনের খাদ্য, সারাদিনের ঘাস, কামলার বেতন- সব হিসেব করলে একটা গরুতে আমার ২০-২৫ হাজার টাকা করে লাভ থাকবে। নিজের পরিশ্রমের কথা বাদ দিলাম। ঘরে চারটা গরু তুলছিলাম। দুইটা গ্রামে বিক্রি হয়ে গেছে। দুইটা এখানে বিক্রি করতে নিয়ে এসেছি।

সাগরিকা বাজারের পাঁচ নম্বর শেডে দুলাল সওদাগরের গরুর খামার। তার ১৭৫টি গরুর মধ্যে প্রায় সবই বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানালেন কর্মচারী ফিরোজ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আমরা এক লাখ ৬০-৬৫ হাজার টাকার মধ্যে গরু বিক্রি করে দিয়েছি। ১০-১৫ হাজার টাকা লাভে বিক্রি করেছি।

কুষ্টিয়ার ব্যাপারী রাশেদুজ্জামান বলেন, লোকাল ব্যাপারীরা যে দামে গরু বিক্রি করতে পারছেন, আমাদের পক্ষে তো সম্ভব নয়। গরুর খরচের সঙ্গে আমাদের চট্টগ্রামে আনা-নেওয়ার পরিবহন খরচ, কামলার বেতন, এখানে কয়েকদিন ধরে থাকা-খাওয়া, হাসিল, পথের খরচ যোগ হয়। চট্টগ্রামের লোকাল গরুর সঙ্গে এই জায়গায় আমরা মাইর খেয়ে গেছি। এজন্য বলছি, আর চট্টগ্রামে আসব না।

চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ের আছিয়া এগ্রো ফার্মের মালিক মো. মহসীন সারাবাংলাকে জানান, তাদের খামারে শাহীওয়াল, সিব্বি, ইন্দো-ব্রাজিল, ক্রস ব্রাহামাসহ বিদেশি বিভিন্ন জাতের ৮০টি গরু ছিল। এর মধ্যে ৪৫টি বিক্রি হয়ে গেছে। বাকি ৩৫টি তিনি আর বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সুইজারল্যান্ড প্রবাসী মহসিন বলেন, আমার কাস্টমার সব চট্টগ্রামের মানুষ। এবার যেটা দেখলাম, চট্টগ্রামে বড় গরুর ডিমান্ড নাই। ছোট গরুর ডিমান্ড বেশি। যে ৩৫টা এবার বিক্রি না করে রেখে দিয়েছি সেগুলো আগামী কোরবানির জন্য রেডি করব। আরও ৩০০টা ছোট গরু রেডি করব। সেগুলো আগামী কোরবানিতে বিক্রি করব।

নগরীর নিমতলার বাসিন্দা মুন্না নামে এক ব্যক্তি বুধবার দুপুরে দুই ঘণ্টা সাগরিকা গরুর বাজারে ঘুরেও কিনতে পারেননি বলে জানালেন। তিনি বলেন, আমরা প্রতিবছর শেষহাটের দিন গরু কিনি। এবার তো কিনতেই পারছি না। যে গরু গতবার এক লাখ টাকার কম দিয়ে কিনেছি, সেগুলো এবার তিন লাখ টাকা দাম চাচ্ছে। কিভাবে গরু কিনব ? খাদ্যের দাম বেশি যেটা বলছে, সেটা একটা অজুহাত। যে গরু দেড় লাখ টাকা দাম চাচ্ছে, সেটা মনপ্রতি হিসেব করলে কসাইয়ের কাছে ৩০ হাজার টাকা। তাহলে কসাই যদি লাভ করতে পারে, ব্যাপারী কেন পারবে না?

নগরীর লাভ লেইনের বাসিন্দা আবু আলম ৪ লাখ ২০ হাজার টাকায় দুটি গরু কিনেছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আমরা ক্রেতা, আমরা স্বাভাবিকভাবেই কম দামে গরু কিনতে চাইব। কিন্তু যারা বিক্রেতা তাদের তো পোষাতে হবে। এবার গরু বিক্রির অবস্থা ভালো না। বাজারে দেখেন, একেকজনের কাছে ১০-২০টা করে গরু রয়ে গেছে, কাস্টমার নাই। এখন ব্যাপারীরা যদি প্রোডাকশন না করে, তাহলে তো বাজার আবার আমদানির দিকে চলে যাবে। দেশের গরু দিয়ে কোরবান তো তখন আর হবে না।

ছবি : শ্যামল নন্দী, ফটোকরেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা

সারাবাংলা/আরডি/আইই

টপ নিউজ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

বাংলাদেশের পরবর্তী অধিনায়ক কে?
৩১ অক্টোবর ২০২৪ ২৩:৩২

আরো

সম্পর্কিত খবর