পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে ‘সিন্ডিকেট’, লাগাম টানতে চায় সরকার
৩ জুলাই ২০২৩ ২২:১২
ঢাকা: নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য মূল্য বৃদ্ধির তালিকায় যোগ হয়েছে কাঁচা মরিচ। গত কয়েকদিনে বাজারে ১০০ টাকা কেজির কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে ঠেঁকেছিল হাজার টাকায়। দেশে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়া সত্ত্বেও কাঁচা মরিচের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সরকারের মন্ত্রীরাও। তারা বলছেন, সিন্ডিকেটের কারণেই বাজারে পণ্যের দাম বাড়ে। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা বাণিজ্যমন্ত্রীর দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন সরকারের কৃষি ও আইনমন্ত্রী। সারাবাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তারা এ বিষয়ে কথা বলেছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে যে পরিমাণে মরিচ উৎপাদন হয়, তাতে আমদানির প্রয়োজন হয় না। সাধারণত প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন অতিবৃষ্টি, বন্যায় প্লাবিত হলে মরিচের গাছ মরে গিয়ে মরিচ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। তখন সরবরাহ কমে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কিন্তু দেশের বাজারে গত কয়েকদিন ধরে হঠাৎ করেই কাঁচা মরিচের দাম বাড়া শুরু হয়।
ঈদের কয়েক দিন আগে থেকে দেশের বাজারে কাঁচা মরিচের দাম বাড়তে শুরু করে। ঈদুল আজহার পরে তা অস্বভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। গত কয়েক দিনে পাইকারি পর্যায়ে কেজি ৪০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল। আর ওই সময় বাজারভেদে খুচরা প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। বাজারে কাঁচা মরিচের দাম আকাশ ছোঁয়া পরিস্থিতিতে গত ২৫ জুন এই নিত্যপণ্য আমদানির অনুমতি দেয় সরকার।
কাস্টমস এর তথ্যানুযায়ী, গত ২৬ জুন পর্যন্ত সোনা মসজিদ ও হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ৩৮ হাজার ৬৭১ কেজি কাঁচা মরিচ আমদানি হয়েছে। ঈদের ছুটি শেষে রোববার (২ জুলাই) আবারও ভারত থেকে কাঁচা মরিচ দেশে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। ঈদুল আজহার ছুটি শেষে গতকাল রোববার থেকে আবারও ভারতীয় কাঁচা মরিচ দেশে প্রবেশ করতে শুরু করেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, দেশে রবি ও খরিপ এই দুই মৌসুমে মরিচের চাষ হয়। চলতি বছর গ্রীষ্মকালীন মরিচ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০ হাজার ৭০০ হেক্টর। বছরটিতে আবাদ হয়েছে ৩৭ হাজার ১২১ হেক্টর জমিতে। আবাদে অগ্রগতির হার ৯০ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬৮৩ হেক্টর জমির মরিচ কাটা হয়েছে। হেক্টর প্রতি গড় ফলন ২.১৯ টন। কর্তনকৃত জমিতে মরিচের উৎপাদন ১ হাজার ৪৪৬ টন। এখন পর্যন্ত মাত্র ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ জমির মরিচ উঠানো হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে কাঁচা মরিচ আবাদি জমির পরিমাণ ১ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। উৎপাদন হয়েছিল ১৪ লাখ ৫৩ হাজার টন। বছরটিতে চাহিদা ছিল ১৫ লাখ টন, আর আমদানি হয়েছিল ১৩ হাজার টন। এই মরিচের দাম সব সময় ক্রেতাদের হাতের নাগালেই থাকে।
বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মহামারির মতো পরিস্থিতি না হওয়া সত্তেও বাজারে কাঁচা মরিচের এই দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিরাও অবাক হয়েছেন। ব্যবসায়ীদের কঠোর সমালোচনা করে ক্ষোভও ঝেড়েছেন। এ প্রসঙ্গে কথা হয় কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধু মরিচই না অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে অন্য অনেক পণ্যের দাম। কিন্তু হঠাৎ করে কাঁচা মরিচের দাম এতটা বাড়বে তা চিন্তাও করতে পারিনি।’ কী কারণে মরিচের দাম এত বেড়েছে? উল্টো প্রশ্ন তোলেন কৃষিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমরা তো বাজার মনিটর করি না। এটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় করে থাকে। তারপরে আমরা বলব, এই দাম বাড়া অস্বাভাবিক। কাঁচা মরিচ দেশে প্রচুর হয়। আমার অভিজ্ঞতা আছে, আমি গ্রামে যাই। সেখানে দেখি কাঁচা মরিচ মাঠে গড়ায়। কৃষকেরা গ্রামে খেত থেকে মরিচ তোলে না, কারণ তোলার দামও ওঠে না।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা শুধু ভোক্তা না কৃষকের স্বার্থও দেখতে চাই। গতবছর পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারেনি কৃষকেরা। অনেক পেঁয়াজ পঁচে গেছে। এ বছর আবার দাম সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দিলো আবার দাম কমে গেছে। এই সিন্ডিকেট তো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। বাড়তি দামের মধ্যে আমদানির ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম কমতে শুরু করল। আমি নিজে ফরিদপুর, পাবনা গিয়েছি কৃষকেরা আমদানির পক্ষে না তারা বলে আমরা দাম পাব না। দাম বাড়ে কিন্তু আমরাও সবশেষ চেষ্টা করি দাম কমানোর জন্য। সরবরাহ কমে গেলে দাম কমবে।’
তাহলে কী সিন্ডিকেট সরকারের চেয়েও শক্তিশালী? এমন প্রশ্ন ছিলো কৃষিমন্ত্রীর কাছে। জবাবে কৃষি মন্ত্রী বলেন, ‘সিন্ডিকেট শক্তিশালী নয়, ওরা চালাকির মাধ্যমে এটি করে ( দাম বাড়ায়)। আমরা চেষ্টা করছি সিন্ডিকেট দূর করার।’
অনেক সময় সরবরাহ কমে গেলে দাম বাড়ে উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের চেষ্টা থাকবে নির্বাচনের আগে বাজারে দ্রব্যমূল্য ঠিক রাখার।’
বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি খুবই দুঃখজনক যে, কোনো কারণ ছাড়াই বাজারে পণ্যের দাম এত বাড়তে পারে।’
তিনি বলেন, ‘ভোক্তাদের পক্ষে অনেক আইন রয়েছে। সেসব আইন সব সময় কার্যকর করা হয় না ‘
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দিকে ইঙ্গিত করে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘মজুদদার প্রতিরোধসহ বিশেষ যে আইনগুলো রয়েছে সেগুলো কার্যকর করে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। আর এ কাজ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কেই করতে হবে।’
এদিকে বাজারে কাঁচা মরিচের দাম কমতে শুরু করেছে। জানা গেছে, গত কয়েক দিনের তুলনায় দেশি কাঁচা মরিচের সরবরাহ যেমন বেড়েছে, তেমনি আমদানি করা কাঁচা মরিচও দেশে আসছে। এতে দেশের পাইকারি মোকামগুলোতে কাঁচা মরিচের দাম আগের তুলনায় বেশ কমেছে।
কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, সোমবার (৩ জুলাই) দেশের মেহেরপুরে কাচা মরিচ খুচরা বিক্রি হয়েছে ৪০০ টাকা, কুস্টিয়ায় ২৮০ টাকা, ফরিদপুরে ২২০ টাকা, পাবনায় ২৪০ টাকা থেকে ২৬০ টাকা, রাজশাহী ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা, ঝিনাইদহে ৩০০ টাকা, রংপুরে ১৫০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা, নওগায় ২৫০ টাকা, রাজবাড়িতে ৪৮০, কিশোরগঞ্জে ৩০০-৩২০ টাকা, ময়মনসিংহে ২৪০ থেকে ৩০০ টাকা, ঠাকুরগাওয়ে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, বগুড়ায় ২৫০ টাকা, যশোরে ৫০০ টাকা এবং চুয়াডাঙ্গায় ৪৮০ টাকা প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে। আর রাজধানীর বাজার ভেদে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত।
সারাবাংলা/জেআর/একে