গঠনতন্ত্র না মেনেই স্বাচিপের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার অভিযোগ
৮ জুলাই ২০২৩ ১১:২৩
ঢাকা: স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগপন্থী চিকিৎসকদের মাঝেই দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। সম্মেলনের প্রায় সাত মাস পর স্বাচিপের পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা করা হয়েছে। এই কমিটিতে সংগঠনের আদর্শ বিরোধী ব্যক্তিদের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনে চলমান মামলায় অভিযুক্ত চিকিৎসক, অনৈতিক কাজে যুক্ত থেকে জেল খাটা আসামিরা প্রাধান্য পেয়েছে বলে অভিযোগ নেতাকর্মীদের। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি সামনে এসেছে তা হলো, দলীয় গঠনতন্ত্র ভেঙে স্বাচিপের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়েছে। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশনা না মেনেই প্রকাশ করা হয়েছে এ কমিটি।
শুধুমাত্র পদবঞ্চিত স্বাচিপ নেতাকর্মীরাই নয় বরং সাবেক নেতাদেরও অভিযোগ, নির্বাচনের বছরে প্রস্তুতির জন্য যেখানে প্রয়োজন ছিল শক্তিশালী কমিটি, সেখানে এমন বিতর্কিত কমিটি সংগঠনকে দুর্বল করবে। ক্ষোভ নিরসনে কিছু নেতাকর্মীকে কো-অপ্ট করে নিলেও সদ্য সদস্য হওয়াদের কমিটিতে স্থান করে দেওয়া মূলত সংগঠনে সবার মাঝে দূরত্ব বাড়াবে। তাই বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়েও ভাবছেন তাই বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা।
২০২২ সালের ২৫ নভেম্বর স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি হিসেবে ডা. জামাল উদ্দীন চৌধুরী ও মহাসচিব হিসেবে ডা. কামরুল হাসানের নাম ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই দুইজনের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি স্বাচিপের বিদায়ী সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান ও মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজের সঙ্গে আলোচনা করে কমিটির বাকি নেতা ও সদস্যদের নাম চূড়ান্ত করতে বলেন।
গত ২৭ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সই এক বিজ্ঞপ্তিতে অনুমোদিত পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা প্রকাশ করা হয়। তবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা দেওয়ার আগে মানা হয়নি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশনা— এমনটাই অভিযোগ স্বাচিপ সংশ্লিষ্টদের।
তবে স্বাচিপের সভাপতি ডা. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘সবকিছু গঠনতন্ত্র মেনেই করা হয়েছে। যারা পদ পাননি তারা কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে এসব কথা বলছেন। কিন্তু কাগজপত্র সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।’
নতুন কমিটি প্রকাশে স্বাচিপের গঠনতন্ত্র মানা হয়নি
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সভাপতি, সহ-সভাপতি, মহাসচিব, কোষাধ্যক্ষ, যুগ্ম মহাসচিব পদের জন্য কমপক্ষে একটানা ১০ বছর এবং অন্যান্য পদের জন্য এক টানা ছয় বছর স্বাচিপের সদস্য পদে বহাল থাকা অপরিহার্য।
সদ্য ঘোষিত কমিটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানা হয়নি গঠনতন্ত্রের এই ধারা। সম্প্রতি সংগঠনের সদস্য হওয়া চিকিৎসকরা ছাড়াও এই কমিটিতে স্থান পেয়েছেন প্রভাবশালী নেতাদের পরিবারের সদস্য ও তাদের পরিচিতরা, যাদের কখনো সংগঠনের কর্মসূচিতে দেখা যায়নি।
স্বাচিপের নেতৃত্বস্থানীয় একজন সারাবাংলাকে বলেন, ২০২২ সালের সম্মেলনের আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. ইসমে আলম জিকো সদস্য হওয়ার ফর্ম নিয়ে সাবেক সভাপতি ও মহাসচিবের কাছে নানাভাবে তদবির করেন। শুধু তাই না, সম্মেলনের দিনও তিনি আবেদন পত্র নিয়ে সাবেক মহাসচিবের পেছনে নানাভাবে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ থাকায় তাকে সদস্যপদ দেওয়া হয়নি। কিন্তু সম্মেলনের পরে নবনির্বাচিত সভাপতি ও মহাসচিব তাকে নতুন কমিটিতে সহ-সম্পাদক পদ দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুবই সক্রিয় ডা. জিকুর সম্প্রতি করা পোস্ট সরকার দলীয় কর্মকাণ্ডের পক্ষে হলেও ২০১৩-১৪ সালের দিকে বিভিন্ন বিতর্কিত পোস্ট শেয়ার দিয়েছিলেন তিনি।
স্বাচিপের সদস্য তালিকায় খুঁজে অবশ্য ডা. জিকুর সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ঘোষিত কমিটির দফতর সম্পাদকই দেশের বাইরে
স্বাচিপের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কমিটিতে দায়িত্ব পাওয়া দফতর সম্পাদকের কাজ সংগঠনের সদস্যদের নিবন্ধ পুস্তকের রক্ষণাবেক্ষণ করা। এর পাশাপাশি প্রেস বিজ্ঞপ্তি বা অন্য যেকোনো ধরনের চিঠি প্রেরণের দায়িত্ব পালন করা। এছাড়াও সভার কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধ করে তা সংরক্ষণ করা। পাশাপাশি অফিসের কর্মচারীদের তত্ত্বাবধান করা।
স্বাচিপের নতুন কমিটির একাধিক সদস্য জানান, দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়া ডা. ইমরান মাহমুদ বর্তমানে উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে অবস্থান করছে। তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঁচ বছর দেশে থাকবেন না। এমন অবস্থায় তাকে দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে খোদ বর্তমান কমিটির অনেকেই অবাক। কমিটি ঘোষণার পরে ৫ জুলাই ইসি মিটিং ডাকা হলেও সেটা কিভাবে কি করা হবে তাও অনেকেই বুঝছিল না।
তবে দফতর সম্পাদক ডা. ইমরান ১৫ জুলাইয়ের মাঝে দেশে ফিরে আসবেন বলে জানান স্বাচিপ সভাপতি ডা. জামালউদ্দিন।
স্বাচিপের সাংগঠনিক রীতি অনুযায়ী আগের কমিটির ন্যূনতম ৪০ শতাংশ সদস্য নতুন কমিটিতে রাখার রেওয়াজ ছিল। যা এবার ভাঙা হয়েছে বলে অভিযোগ নেতাকর্মীদের।
এদিকে স্বাচিপের অফিসিয়াল ওয়েব সাইটটি বর্তমানে অকার্যকর অবস্থায় আছে। দফতর সম্পাদক না থাকায় এটির বিষয়ে কোনো অগ্রগতি জানাতে পারেনি কেউ। তবে দফতর সম্পাদক কবে দেশে আসবেন, সেই বিষয়ে কেউ পরিষ্কারভাবে কিছু জানাতে পারেননি।
সাবেক ছাত্রদল কর্মীদেরও কমিটিতে স্থান দেওয়ার অভিযোগ
স্বাচিপের নতুন কমিটির সদস্য ডা. মোহাম্মদ রাকিব ছাত্রাবস্থায় ইসলামী ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলেও অভিযোগ সংগঠনটির নেতাকর্মীদের। এছাড়া কমিটির সহ-দফতর সম্পাদক ডা. কাওছার আলম ছাত্রদলের রংপুর মেডিকেল কলেজের শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হোস্টেল কমিটির ২০০৬-০৭ সেশনের সহ-সম্পাদক ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্বাচিপ সংশ্লিষ্টরা।
নতুন কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে আছে দুর্নীতির অভিযোগ
স্বাচিপের নতুন কমিটির প্রথম যুগ্ম মহাসচিব ডা. সোহেল মাহমুদ ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে চাকরি করার সময় টাকার বিনিময়ে হত্যার ঘটনাকে আত্মহত্যার রিপোর্ট দিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। একইভাবে ধর্ষণ মামলার ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে উল্টো রিপোর্ট দিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। সেই অভিযোগে ১/১১ পর তাকে গ্রেফতার করেছিল র্যাব। এছাড়াও নতুন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. মাহবুবুর রহমান বাবুর দুর্নীতির অনুসন্ধান শেষ পর্যায়ে।
নতুন কমিটির আরও অনেক সদস্যদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি দমন কমিশনে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার বিচার কাজ চলমান বলে জানিয়েছেন স্বাচিপ সংশ্লিষ্টরা।
কী বলছেন সাবেক সভাপতি ও মহাসচিব?
স্বাচিপের সাবেক সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সলান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কমিটির বিষয়ে আমার সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। আমাদের বর্তমান সভাপতি একদিন ফোন দিয়ে কিছু নাম জমা দিতে বলেছিলেন। কিন্তু সেটা তো কোনো রীতি বা সংগঠনের ধারার মাঝে পড়ে না। দলীয় কার্যালয়ে বসে সাবেক ও বর্তমানরা মিলেই কমিটি চূড়ান্ত করার কথা। তেমন কিছু হয়নি এই কমিটির ক্ষেত্রে।’
স্বাচিপের বিদায়ী মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংগঠনের রেওয়াজ অনুসারে বিদায়ী সভাপতি ও মহাসচিব হিসেবে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। উভয় কমিটির নেতাদের যৌথ স্বাক্ষরে কমিটি হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। বিতর্কিত ব্যক্তি, সাবেক ছাত্রদল ও শিবির কর্মীদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার তথ্য আমাদের কাছে এসেছে।’
কী বলছে বর্তমান কমিটি?
স্বাচিপের বর্তমান সভাপতি ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে সব অভিযোগের বিষয়ে জানানো হয়েছে তা সবই ভুল ও বানোয়াট। বিগত সময়ে যারা স্বাচিপের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না তারা পদ বঞ্চিত ও ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে এমনটা করছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যাচাই-বাছাই করেই সদস্যদের নিয়েছি। তারা প্রত্যেকেই ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।’
কমিটিতে ছাত্রদল ও জামায়াত শিবির সদস্য অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিএনপি জামায়াতের সময়ে তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে এবং হলে সিট পেতে কেউ কেউ হয়তো তাদের সহযোগিতা নিয়েছিলেন।’
দুদকের মামলায় অভিযুক্তদের বিষয়ে ডা. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারি না।’
সারাবাংলা/এসবি/এনএস