আসন পুনরুদ্ধারে জাপার ভরসা মোস্তাকেই, আ.লীগ-বিএনপিতে কোন্দল
৮ জুলাই ২০২৩ ১৮:৩৩
কুড়িগ্রাম: একসময় কুড়িগ্রাম ছিল জাতীয় পার্টির ঘাঁটি। এই জেলার সবক’টি আসনই তাদের দখলে থাকতো। কিন্তু এখন সেই চিত্র আর নেই। টানা মেয়াদে থাকা আওয়ামী লীগের দখলে চলে গেছে জেলার তিনটি আসন। সেজন্য মাঠে আওয়ামী লীগের অবস্থান আগের চেয়ে শক্ত। তবে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও রয়েছে প্রবল। আর আসনগুলোতে বিএনপির একাধিক শক্তিশালী প্রার্থী থাকায় তারাও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন। এদিকে, জাতীয় পার্টি তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে এবার মরণ কামড় দেবে— এমন আলোচনা রাজনৈতিক মহলে। আর কুড়িগ্রামে চরমোনাইর পীরের অনেক অনুসারী থাকায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভোটের মাঠে তারাও ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে।
নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে কুড়িগ্রামের চারটি আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। মাঠে-ঘাটে ভোটের উত্তাপ বইতে শুরু করেছে। চলছে সম্ভাব্য প্রার্থীর দোষ-গুণ নিয়ে আলোচনা। এদিকে, মনোনয়ন প্রত্যাশীরা পরিচিতি বাড়াতে নিজের ছবি সম্বলিত বিলবোর্ড, ফেস্টুন ও ডিজিটাল ব্যানার লাগিয়ে সরগরম করে তুলছে ভোটের মাঠ। সেইসঙ্গে মনোনয়নের জন্য দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও তদবিরও রক্ষা করে চলছেন তারা। ফলে দলে বাড়ছে গ্রুপিং-লবিং।
নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলা নিয়ে গঠিত কুড়িগ্রাম-১ আসন। এই আসনটি ৩০ বছর জাতীয় পার্টির দখলে থাকলেও গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আসলাম হোসেন সওদাগর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে আসনটি ফের জাতীয় পার্টির দখলে নিতে তৎপর কয়েকবারের সংসদ সদস্য একেএম মোস্তাফিজুর রহমান। অন্যদিকে, দলীয় কোন্দল আর একাধিক প্রার্থী নিয়ে অনেকটাই অগোছালো আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিন সরকারে থাকার কারণে স্থানীয় নেতাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে সাধারণ মানুষদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা কমে গেছে। যার প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়বে বলে মনে করছেন সাধারণ ভোটাররা।
যদিও টানা মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় সরকার এই আসনে ব্যাপক উন্নয়ন-কর্মকাণ্ড করেছে। তারপরও সাধারাণ ভোটাররা সিদ্ধান্তহীনতায়। সে কারণে এই আসনে জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে এবার আওয়ামী লীগকে যোগ্য ও ত্যাগী প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে। তবে স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কুড়িগ্রাম-১ আসনটিতে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেয় তবে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তবে এই আসনে বিএনপিতেও রয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। অবস্থা এমন যে, কেউ কাউকে মানতে চাইছে না। এদিকে, এই আসনের ভুরুঙ্গামারী এলাকা প্রবীণ নেতা মরহুম শামসুল হক চৌধুরী (তৎকালীন গভর্নর) জন্মস্থান হওয়ায় আওয়ামী লীগের একটি ভোট ব্যাংক রয়েছে। প্রতিবার নির্বাচনে এই ভোট ব্যাংকই আওয়ামী লীগ কাজে লাগায়। তারপরও এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্যকে দলের অনেক নেতা-কর্মীই অপছন্দ করেন। এমনকি এই আসনে দলটির প্রকাশ্য দ্বন্দ্বও রয়েছে বলে জানা গেছে। সেজন্য প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলটিকে আরও সতর্ক হতে হবে বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
নির্বাচনের তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৯১ সালে এই আসনে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির এ কে এম সহিদুল ইসলাম বাচ্চু। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দলীয় প্রার্থী সাইফুর রহমান রানা নির্বাচিত হলেও একই বছরের জুনে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাকের হাত ধরে আসন ফিরে পায় জাপা। এরপর ২০০১, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম, নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির পতাকা ধরে রাখেন মোস্তাক। একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রথম বারের মতো আসনটি নিজেদের দখলে নেয় আওয়ামী লীগ। নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন আসলাম হোসেন সওদাগর। আগামী সংসদ নির্বাচনে এ আসনটি জাতীয় পার্টির দখলে নেওয়ার লক্ষ্যে সাবেক এমপি মোস্তাকের ওপরই ভরসা দলটির। তৃণমূলে জনপ্রিয় সাবেক এই এমপি’র দলীয় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই বলে দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
নিজের প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে মনোনয়ন চাইব। সে অনুযায়ী কাজ করছি। আমি আমার গ্রহণযোগ্যতা এর আগের নির্বাচনগুলোতে জয়লাভের মাধ্যমে প্রমাণ করেছি।’
তবে জাপার একক প্রার্থী থাকলেও বড় দুই দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে তরুণ প্রার্থীসহ একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন। যদিও দল দুটির মধ্যে একাধিক গ্রুপ সৃষ্টি হয়ে আন্তঃকোন্দল দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে বর্তমান এমপি ছাড়াও মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন- ভূরুঙ্গামারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুন্নবী চৌধুরী খোকন, নাগেশ্বরী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা জামান, জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক মাজহারুলই ইসলাম মাজু, কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপস্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক তরুণ চিকিৎসক ডা. মাহাফুজার রহমান উজ্জ্বল।
নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ভূরুঙ্গামারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুন্নবী চৌধুরী খোকন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পারিবারিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগেরর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চাইব। তবে দল যাকে যোগ্য মনে করে মনোনয়ন দেবে দলের স্বার্থে তার জন্য কাজ করব।’ নুরুন্নবী চৌধুরী খোকনের ছেলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনও জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে, বর্তমান এমপির সমালোচনা করে আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী মোস্তফা জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমান এমপি’র দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। জনসংযোগ তো দূরের কথা দলীয় কোনো কার্যক্রমেও তিনি অংশ নেন না। দুই মাস আগে দলের কাউন্সিল হলেও আজ পর্যন্ত তিনি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেননি।’
নিজের মনোনয়ন পাওয়ার দাবির প্রতি জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি নিয়মিত জনসংযোগ করছি। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে সরকারের উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছি। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে তাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি। আমার প্রত্যাশা, দল তৃণমূলের কথা শুনলে আমি মনোনয়ন পাব এবং নৌকার জয় নিশ্চিত করতে পারব।’
এদিকে, কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা ‘৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জয়ী হলেও মেয়াদ পূর্ণ না করার অতৃপ্তি মেটাতে ফের এই আসনে লড়বেন বলে জানা গেছে। যদিও এই প্রতিবেদকে তিনি জানিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তার দল ও তিনি প্রার্থিতা নিয়ে ভাবছেন না। দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই আসনে বিএনপির একাধিক গ্রুপ সক্রিয়। এদের মধ্যে মনস্তাত্বিক কোন্দল রয়েছে।
কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বসহ সাইফুর রহমান রানার এক তরফা সিদ্ধান্তে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। ফলে রানার সঙ্গে একাধিক তরুণ নেতার মনোনয়ন নিয়ে দরকষাকষি হতে পারে। ড্যাব নেতা ডা. মো. ইউনুছ আলী ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি গোলাম রসুল রাজা দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। সে লক্ষ্যে এই তরুণ নেতারা জনসংযোগও চালিয়ে যাচ্ছেন। সর্বশেষ, একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে বিএনপির প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। ওই নির্বাচনে সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন বি এনপির প্রার্থী সাইফুর রহমান রানা।
অপরদিকে, এই আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশর ভোটার ও জনসর্মথন রয়েছে বলে দাবি করেছেন দলটির নেতারা। আসন্ন নির্বাচনে এই আসনে গোলাম মোস্তফা, মো.আনসার আলী রয়েল ও হাবিবুল্লাহ বেলালি মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, এই আসনটিতে মোট ভোটার ৪ লাখ ৬১ হাজার ৪১৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ২৭ হাজার ৮০৫ জন, নারী ভোটার ২ লাখ ৩৩ হাজার ৬১১ জন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আছলাম হোসেন সওদাগর ১ লাখ ২৩ হাজার ৪৭৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সাইফুর রহমান রানা পান ১ লাখ ১৯ হাজার ২২৭ ভোট। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে জয়লাভ করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি ৭৪ হাজার ৪২৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল হাই পান ৩০ হাজার ১৭২ ভোট। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও মোস্তাফিজুরের দখলে ছিল আসনটি। ওই নির্বাচনে জাপার মনোনয়নে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে ২ লাখ ৯ হাজার ৮৯৯টি ভোট পেয়ে জয়ী হন তিনি। ওই নির্বাচনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সাইফুর রহমান রানা ধানের শীষ প্রতীকে পান ৯২ হাজার ৫৮৩ ভোট।
সারাবাংলা/জেআই/পিটিএম
আসলাম হোসেন সওদাগর কুড়িগ্রাম-১ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নূরুন্নবী চৌধুরী খোকন মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন সাইফুর রহমান রানা