হাসপাতালে ভর্তির ৩ দিনেই মারা যাচ্ছে ৮০% ডেঙ্গু রোগী
৮ জুলাই ২০২৩ ২৩:১৮
ঢাকা: চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে— এমন আশঙ্কা ছিল বছরের শুরু থেকেই। সেই আশঙ্কাকে বাস্তবতায় রূপ দিয়ে দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। ৮ জুলাই পর্যন্ত দেশে ৬৭ জন মারা গেছে। এর মাঝে ৫০ জনের মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রথম তিন দিনেই মারা যাচ্ছে ৮০ শতাংশ রোগী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতিতে গুরুত্ব না দিয়ে মশা নিধন কার্যক্রমে সমন্বহীনতার প্রভাব দেখা যাচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এসে। আর তাই অবস্থার উত্তরণের জন্য নাগরিক সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধ করা।
চিকিৎসকরা বলছেন, এবারের ডেঙ্গুতে খুব দ্রুতই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে নানা কারণে। এর মাঝে অন্যতম হলো রোগীদের ভিন্ন ভিন্ন সেরোটাইপে আক্রান্ত হওয়া ও দেরিতে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা। আবার অনেক ক্ষেত্রেই রোগীরা সময়মতো নমুনা পরীক্ষাও করাচ্ছে না আর তাই পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হচ্ছে।
চলতি বছরের ২ জুলাই পর্যন্ত ৫০ জন রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হাসপাতালে ভর্তির ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ১৪ শতাংশ রোগী মারা যাচ্ছে। এছাড়াও ১১ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে ছয় শতাংশ রোগী।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর দেশের একজন প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগ আমাদের দেশে দীর্ঘ সময় ধরেই আছে। অনেকেই দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন সময় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। আবার অনেকে দেখা গেছে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও পরীক্ষা না করানোর কারণে প্রথমবার বুঝতেই পারে নাই। এমন রোগীরা যখন দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছে ভিন্ন সেরোটাইপে তখন তারা গুরুতর হচ্ছে। শুধু তাই না, অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নমুনা পরীক্ষা দেরি করা হচ্ছে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসাও একটা অন্যতম কারণ। সব মিলিয়ে হাসপাতালে যখন আসছে তখন আসলে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘জ্বর এলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেই হবে। এ ছাড়া ডেঙ্গু শনাক্তে জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করায়ে নিশ্চিত হতে হবে। এগুলো হলো বেসিক। স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতালগুলো আছে। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত না হওয়ার জন্যেও কিন্তু সবার চেষ্টা করতে হবে। কারণ মশা না মারলে কিন্তু একটা মানুষও নিরাপদ না।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। কিন্তু বাসায় বা এলাকায় যদি মশার বংশ বিস্তার রোধ না করা যায় তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য হবে। এ জন্য সবাই মিলেই চেষ্টা করে যেতে হবে।’
ডেঙ্গুর কোনো ধরনের আক্রান্ত রোগী বাড়ছে?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বছর ডেঙ্গুর ধরন (ভেরিয়েন্ট) ডেন-২-এ বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। সীমিতসংখ্যক নমুনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ রোগী ডেঙ্গুর ধরন ডেন-২-এ আক্রান্ত হয়েছেন। বাকি ৩৮ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন অন্য ধরন ডেন-৩। আইইডিসিআর ডেঙ্গুর ধরন সম্পর্কে এ তথ্য জানিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকে আইইডিসিআর ডেঙ্গুর সেল পর্যবেক্ষণ করছে। এ পর্যন্ত ভাইরাসের চারটি ধরন পাওয়া গেছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত আমাদের সার্কুলেশনে স্ট্রেইন-১ ও ২ ছিল। ২০২১ সালে স্ট্রেইন ৩-এর প্রকোপ দেখা দেয়। কিন্তু ২০২২ সালে স্ট্রেইন ৪-এর উপস্থিতি মিলেছে। এবার ঢাকায় ডেন-ফোরের উপস্থিত পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে কক্সবাজারে ডেন-ওয়ান, ডেন-থ্রি ও ডেন-ফোর সেরোটাইপ ডেঙ্গু হচ্ছে। একাধিক সেরোটাইপে সংক্রমণ ঘটায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি হয় ২০২২ সালে। তবে আমরা এ বছরের পরিস্থিতি এখনও পর্যবেক্ষণ করছি।’
বেশি মৃত্যু মুগদা হাসপাতালে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে মৃত ৬৭ জনের মধ্যে ৫১ জনই মারা গেছে ঢাকা মহানগরীতে। এর মাঝে ২০ জনই মারা গেছে রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে দুইজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক জন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন।
এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি মেডিক্যালে মারা গেছেন ১১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। এর মাঝে আজগর আলী হাসপাতালে পাঁচ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন। এছাড়া বারডেম হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল ও কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে দুইজন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন।
ঢাকা বাইরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১০ জন, ময়মনসিংহে দুইজন, রংপুর বিভাগে একজন, বরিশালে একজন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন।
কী বলছে কর্তৃপক্ষ?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এডিসবাহী রোগ নির্ণয় কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. ইকরামুল হক বলেন, প্রথমেই ডেঙ্গুবাহিত মশার উৎস শনাক্ত এবং ধ্বংস করা জরুরি। ডেঙ্গু কারও একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ প্রতিটি সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রয়োজন আছে জনসচেতনতা তৈরির জন্য।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, ডেঙ্গু যখন কোনো কমিউনিটিতে প্রবেশ করে, তখন তাকে একেবারে নির্মূল করা যায় না। যেহেতু সামনে আরও নগরায়ণ হবে, আরো উন্নয়ন হবে, আমাদের আগেভাগে মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।’
পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?
কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘অন্যান্যবারের তুলনায় এবার জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত রোগীর যে সংখ্যা দেখা গেছে তা উদ্বেগজনক। এই সময়ে ১২ জন মারা গেছে যা অবশ্যই অপূরণীয় ক্ষতি। অথচ এখন পর্যন্ত কিন্তু বৃষ্টি তেমনভাবে শুরু হয়নি। আর তাই সামনের দিনগুলোতে সবাই সতর্ক না হলে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘হটস্পট ব্যবস্থায় ব্যর্থ হওয়ার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগী যেসব এলাকা থেকে বেশি আসে, সেখানে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। দরকার হলে সেখানে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। তা হলে এক রোগী থেকে অন্য রোগী আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। যদি এমনটা না হয় তবে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার সব জায়গায় ডেঙ্গু রোগীর হার সমান নয়। যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি, সেখানে মশক নিধনের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। মাইকিং, জনসচেতনতা, ওষুধ ছিটানো— সবকিছু একসঙ্গে করতে হবে। এমনটা না করতে পারায় এখন পর্যন্ত জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু।’
অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমরা একটা জরিপ করে দেখেছি যে, এদেশের মানুষ এডিস মশা কীভাবে হয়, প্রজননস্থল, বদ্ধ, স্বচ্ছ পানি- এই সবকিছুই জানে। তারপরও তারা সচেতন হন না। এটি একটা মানসিকতা। এর পরিবর্তন দরকার। আর সিটি করপোরেশন যতই বলুক তারা মশার উৎস ধ্বংস করছে। কিন্তু উড়ন্ত এডিস মশা থেকে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন কিন্তু ডেঙ্গু শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি প্রায় সারাদেশেই ছড়িয়েছে। আর তাই সারা দেশেই স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করার জন্য। নতুবা পরিস্থিতি আসলে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। এখন থেকেই আমাদের মশার প্রজনন ঠেকাতে হবে। মশার প্রজনন যদি আমার মৌসুমের শুরুতেই ঠেকাতে পারি, তাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। বাসাবাড়ি বা আশপাশে যেন পানি জমা না থাকে, পানি জমার মতো কোনো পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়, কোথাও যেন পরিত্যক্ত টায়ার বা কোনো ধরনের পাত্র পড়ে না থাকে, এই বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’
ধ্বংস করতে হবে মশার প্রজননক্ষেত্র
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু যে দেশে ঢোকে, সেখান থেকে বের হয় না। কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের দেশে দুই যুগের বেশি সময় ধরে এর নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ করা হয়নি। ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলেও এর নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। আর তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি একটি সঠিক কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে।’
ডেঙ্গু সংক্রমণ বিষয়ে সতর্ক করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘বাংলাদেশে কিছু দিন ধরে ফের ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রভাব বাড়ছে। এই সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে হলে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।’
জাহিদ মালেক বলেন, ‘সবাইকে নজর রাখতে হবে যে, বাসাবাড়ির ছাদ ও আঙিনায় যেন পানি জমে না থাকে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশার কামড় থেকে মুক্ত থাকতে হবে। আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।’
সারাবাংলা/এসবি/একে