জাপার পনিরের শক্ত অবস্থানে দখল নিতে চায় আ.লীগ প্রার্থী
৯ জুলাই ২০২৩ ০৮:০০
কুড়িগ্রাম: একসময় কুড়িগ্রাম ছিল জাতীয় পার্টির ঘাঁটি। এই জেলার সবক’টি আসনই তাদের দখলে থাকতো। কিন্তু এখন সেই চিত্র আর নেই। টানা মেয়াদে থাকা আওয়ামী লীগের দখলে চলে গেছে জেলার তিনটি আসন। সেজন্য মাঠে আওয়ামী লীগের অবস্থান আগের চেয়ে শক্ত। তবে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও রয়েছে প্রবল। আর আসনগুলোতে বিএনপির একাধিক শক্তিশালী প্রার্থী থাকায় তারাও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন। এদিকে, জাতীয় পার্টি তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে এবার মরণ কামড় দেবে— এমন আলোচনা রাজনৈতিক মহলে। আর কুড়িগ্রামে চরমোনাইর পীরের অনেক অনুসারী থাকায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভোটের মাঠে তারাও ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে।
নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে কুড়িগ্রামের চারটি আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। মাঠে-ঘাটে ভোটের উত্তাপ বইতে শুরু করেছে। চলছে সম্ভাব্য প্রার্থীর দোষ-গুণ নিয়ে আলোচনা। এদিকে, মনোনয়ন প্রত্যাশীরা পরিচিতি বাড়াতে নিজের ছবি সম্বলিত বিলবোর্ড, ফেস্টুন ও ডিজিটাল ব্যানার লাগিয়ে সরগরম করে তুলছে ভোটের মাঠ। সেইসঙ্গে মনোনয়নের জন্য দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও তদবিরও রক্ষা করে চলছেন তারা। ফলে দলে বাড়ছে গ্রুপিং-লবিং।
কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট ও ফুলবাড়ী উপজেলা নিয়ে কুড়িগ্রাম-২ আসন। এই আসনের একটি অংশ জেলা সদর হওয়ায় চারটি সংসদীয় আসনের মধ্যে এর গুরুত্ব বেশি। তবে আসনটি বেশিরভাগ সময় জাতীয় পার্টি ও বিএনপির দখলেই ছিল। বর্তমান এই আসনের এমপি জাতীয় পার্টির পনির উদ্দিন আহমেদ। পুরো জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে এই আসনটি দখলে রাখতে চায় সবদল। এ পরিপ্রেক্ষিতে আগামী নির্বাচনে এই আসনটিতে জয়ের পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে জোরদার করেছে সরকারি দল। সেইসঙ্গে তুলে ধরা হচ্ছে সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি।
আরও পড়ুন: আসন পুনরুদ্ধারে জাপার ভরসা মোস্তাকেই, আ.লীগ-বিএনপিতে কোন্দল
জেলার উন্নয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি খুশি সাধারণ ভোটাররাও। তারপরও মহাজোটের অংশীদারিত্বে এই আসন ছাড়তে নারাজ জাপা। কিন্তু আগামী নির্বাচনে আসনটিতে কোন দলের প্রার্থী মনোয়ন পাবেন তা কেউই জানেন না। তবে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী মনোনয়নের জন্য কেন্দ্রে জোর লবিং শুরু করছেন। জানা গেছে, এই আসনে আওয়ামী লীগ দু’টি গ্রুপে বিভক্ত। এতে বিভক্তি বাড়ছে সাধারণ ভোটারদের মাঝেও। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বড় দলে বিভক্তি খুব স্বাভাবিক। তবে নির্বাচন এলেই বিভক্তি থাকবে না। নেত্রী যাকে মনোনয়ন দেবেন তার পক্ষেই সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ এই আসনে নির্বাচিত হন। কিন্তু তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জাফর আলী বিপুল ভোটে বিএনপি প্রার্থী তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে পরাজিত করেন। এমপি নির্বাচিত হয়ে জাফর আলী দলীয় সহায়তায় কুড়িগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছেন বলে দাবি নেতাকর্মীদের। তাই জনপ্রিয়তার দিক থেকে তিনি এগিয়ে রয়েছেন।
কুড়িগ্রাম-২ আসনে বিএনপির অবস্থান আগে মোটামুটি ভালোই ছিল। কিন্তু বর্তমানে দলের মধ্যে দু’টি গ্রুপ থাকায় জনপ্রিয়তা কমেছে। বিএনপির দু’টি গ্রুপের মধ্যে একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা, অন্যটির নেতৃত্বে সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম। আসনটিতে বিএনপির মোটামুটি ভালো ভোট-ই রয়েছে। কিন্তু দলে বিভক্তির কারণে তাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। সময় যত এগিয়ে আসছে ততই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছেন তারা।
খোজঁ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে জাতীয় পার্টিতেও কোন্দল বেড়েছে। জেলা ও উপজেলায় পাল্টাপাল্টি কমিটির কারণে সাংগঠনিক তৎপরতায় ভাটা পড়েছে। অভিযোগ রয়েছে, জেলায় জাতীয় পার্টি বলতেই বর্তমান এমপি পনির উদ্দিন আহমেদ। তিনি তার পছন্দের লোকজনদের দিয়ে তার কর্মকাণ্ড চালান। এদিকে, জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে নেমেছেন বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক মেজর (অব.) আব্দুস সালাম। তিনি নির্বাচনি এলাকায় গণসংযোগও শুরু করেছেন। সারাবাংলাকে আব্দুস সালাম জানান, তিনি মনোনয়নের ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী। তবে দলের বিভিন্ন সূত্র বলছে, বর্তমান এমপি পনির উদ্দিনও জোর লবিং শুরু করছেন মনোনয়নের জন্য। যদি এবারের নির্বাচনেও মহাজোট থাকে তাহলে জাতীয় পার্টি এই আসনটি চাইবে। তারা কোনো অবস্থাতেই আওয়ামী লীগকে ছাড় দেবে না।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মহাজোটসঙ্গী জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে বিজয়ী করলেও এমপির কাছ থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে পারছেন বলে দাবি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের। সরকারি সব বরাদ্দে এমপির একছত্র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বলে অভিযোগ তাদের। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বঞ্চিত করাসহ সমন্বয়হীনতার অভিযোগ উঠেছে জাতীয় পার্টির এই এমপির বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় সাংগঠনিক স্বার্থে হেড কোয়ার্টার হিসেবে জেলা সদরের এই আসন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৎপর ক্ষমতাসীন দল।
এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন- সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাফর আলী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমান উদ্দিন আহম্মেদ মঞ্জু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এজিএস জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক চলচ্চিত্র পরিচালক আবু সুফিয়ান। তারা সবাই যার যার মতো করে গণসংযোগ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমান উদ্দিন আহম্মেদ মঞ্জু সারাবাংলাকে বলেন, ‘মহাজোটের বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির পনির উদ্দিন আহমেদ কারও সঙ্গে কোনো কিছু সমন্বয় করছেন না। ফলে জনগণ সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই উন্নয়নের স্বার্থে আমরা কুড়িগ্রাম-২ আসনে আমাদের দলীয় প্রার্থী চাই। এবং আমি নিজেও মনোনয়ন চাইব।’ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্রহাম লিংকন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি গ্রামে-গঞ্জে ছুটছি। নেত্রী যদি একবার সুযোগ দেন তাহলে জেলার ভাগ্য পরির্বতনে সর্বাত্মক চেষ্টা করব।’
জাতীয় পার্টির এমপি পনির উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগামী নির্বাচনও মহাজোটের অধীনে হবে। জোটের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। জোট যাকেই মনোনয়ন দেবে আমি তার পক্ষেই কাজ করব। তবে অবশ্যই জাতীয় পার্টি থেকে আমি মনোনয়ন চাইব।’
আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত প্রার্থী নিয়ে চিন্তার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা। তারা আন্দোলনের মধ্যে আছেন এবং আন্দোলন সফল হওয়ার পরই তারা প্রার্থী নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবেন। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘এই আসনে আমাদের প্রচুর ভোটার রয়েছে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে হলে ফলাফল যাবে আওয়ামী লীগের ঘরে। তাই আমরা তত্ত্বাবধায় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জোর দাবি নিয়ে আন্দোলনে আছি।’
তবে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে কুড়িগ্রাম-২ আসন থেকে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাড. রুহুল কবির রিজভী অথবা জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-সম্পাদক সোহেল হোসাইন কায়কোবাদের প্রার্থী হওয়াও সম্ভবনা রয়েছে। এদের বাইরে ব্যারিস্টার রবিউল আলম সৈকতের নামও শোনা যাচ্ছে।
এদিকে, চরাঞ্চল অধ্যুষিত এই আসনে নিজেদের আধিপত্য দিন দিন বাড়াচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে এই আসনের একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থীর বিজয়কে মাঠ পরীক্ষা হিসেবে নিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলা সভাপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সারাবাংলাকে জানান, আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনও তাদের তৎপরতা শুরু হয়নি। তারা শুধু দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ থাকলে দল থেকে তিনি নিজেই প্রার্থী হবেন। তবে সহযোগী সংগঠন ইসলামী শ্রমিক আন্দোলনের জেলা সভাপতি মো. শাহাজাহান মিয়া ও ডা. আবুল কালাম আজাদ দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, এই আসনটিতে মোট ভোটার ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৩৩৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২লাখ ৪৩ হাজার ৭৩৮ জন ও নারী ভোটার ২ লাখ ৪৯ হাজার ৫৯৮ জন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোট প্রার্থী জাতীয় পার্টির পনির উদ্দিন আহমেদ বিজয়ী হন। লাঙ্গল প্রতীকে তিনি পান ২ লাখ ২৯ হাজার ৪৪৩ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন গণফোরামের আমসা আমিন। তিনি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে পান ১ লাখ ৭ হাজার ১৪৬ ভোট। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে জাতীয় পার্টির তাজুল ইসলাম চৌধুরী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জাতীয় পার্টির দখলে ছিল আসনটি। সেবার নির্বাচনে জয়ী হন জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি এএইচএম এরশাদ। লাঙ্গল প্রতীকে তিনি পান ২ লাখ ৯ হাজার ৫০৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির তাজুল ইসলাম চৌধুরী। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান ৫২ হাজার ৩৭৪ ভোট।
সারাবাংলা/জেআই/পিটিএম
আওয়ামী লীগ আবু সুফিয়ান আব্রহাম লিংকন আমান উদ্দিন আহম্মেদ মঞ্জু ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কুড়িগ্রাম-২ আসন জার্তীয় পার্টি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পনির উদ্দিন আহমেদ বিএনপি মো. জাফর আলী