বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর: পাল্টে গেছে উত্তরের জনপদ
৯ জুলাই ২০২৩ ২৩:১৭
পঞ্চগড় থেকে: নতুন কলেবরের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরকে ঘিরে পাল্টে গেছে উত্তরের জনপদ। নতুন রূপ পেয়েছে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো। বদলে গেছে এখানকার মানুষের জীবনযাপন। বেড়েছে ব্যবসা বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর হয়ে প্রতিদিন ভারতে যাওয়া-আসা করছে উত্তরের মানুষ।
উত্তরাঞ্চলের সর্বশেষ সীমানায় অবস্থিত এই বন্দর ঘিরে বেড়েছে পর্যটকসহ দর্শনার্থী। এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এই অঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আর আমদানি রফতানি বাড়ায় বেড়েছে বন্দরের আয়ও। সরেজমিনে পঞ্চগড়, বাংলাবান্ধা ও ঠাকুরগাঁও ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
শনিবার (৮ জুলাই) দুপুরে এই প্রতিবেদক বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে অবস্থান করছিলেন। এসময় বাংলাদেশ থেকে ভারতে ও ভারত থেকে বাংলাদেশে অনেককেই যাওয়া আসা করতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে কেউ যাচ্ছেন চিকিৎসা নিতে আবার কেউবা গিয়েছিলেন ব্যবসায়িক কাজে। আবার এই বন্দর হয়ে শিক্ষার্থীরাও যাচ্ছেন ভারত ও নেপালে। তাদেরই একজন ঠাকুরগাঁওয়ের মাজেদুল ইসলাম। গত বুধবার স্ত্রী সোমা আক্তারকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। চিকিৎসা শেষে শনিবার এ বন্দর দিয়ে দেশে ফেরেন তারা।
আলাপকালে সারাবাংলাকে মাজেদুল বলেন, ‘আগে বুড়িমারী বন্দর দিয়ে ভারতে যেতে হতো, নতুবা ঢাকায় যেতে হতো। এতে খরচ যেমন বেশি ছিল, তেমনি ভোগান্তিও ছিল অনেক। এখন মাত্র কয়েকঘণ্টা লাগে ভারতে যাওয়া-আসায়। আগে আমাদের এই সুযোগ ছিল না।’
মাজেদুল আরও বলেন, ‘কয়েকবছর হয়েছে বন্দরে ইমিগ্রেশন চালু হয়েছে। ফলে আমরা উত্তরের মানুষ খুবই উপকৃত হয়েছি। এ এলাকার রাস্তাঘাটের চিত্র বদলে গেছে। ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। স্বাধীনতার পর এমন উন্নয়ন হয়নি। গত কয়েক বছরেই এই উন্নয়ন হয়েছে।’
পঞ্চগড়ের ব্যবসায়ী জয়দেব কুন্ডু। দুই সন্তানের এই জনক জানান, তার সন্তানেরা ভারতে লেখাপড়া করে। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে কথা হলে সারাবাংলাকে তিনি জানান, সন্তান ও স্ত্রীকে ইমিগ্রেশন পার করে দিতে এসেছেন। ছুটিতে তার ছেলে-মেয়ে দেশে এসেছিল। সঙ্গে থাকা স্ত্রী যাচ্ছেন বেড়াতে।
তিনি বলেন, ‘ছেলে মেয়ে ভারতে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। ভারতে পড়াতে খরচ কম। পঞ্চগড়ে ওই মানের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নেই। যদি দেশে পড়াতে হয় তাহলে ঢাকায় যেতে হবে। ঢাকায় যেতে হলেও ১২-১৪ ঘণ্টার রাস্তা। আর ভারতের কার্শিয়ানে দুই-আড়াই ঘণ্টা। ফলে বাধ্য হয়েই তাদের ভারতে পড়াতে হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন বাড়ি থেকে সকালের নাস্তা করে বের হলে ভারতে গিয়ে দুপুরের খাওয়া যায়। আর সকালে রওনা দিয়ে ভারত থেকে এসেও দেশে দুপুরের ভাত খাওয়া যায়। এর চেয়ে আনন্দের আর কি আছে! আগের সেই ভোগান্তি নেই।’
জয়দেবের মেয়ে জয়ী কুন্ডু সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে এক মাস ছিলাম। এখন ক্লাস শুরু হবে। তাই যাচ্ছি। মাস খানেকের মধ্যেই আবার দেশে চলে আসব।’
ব্যবসায়ী জয়দেব কুন্ডুও জানান, মাসে বেশ কয়েকবার তার ভারতে যাওয়া আসা হয়। কোনো ধরনের হয়রানি কিংবা বিড়ম্বনা নেই। ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষ করতে মাত্র আধা ঘণ্টার মতো সময় লাগে।
বেলা সাড়ে ৩টা থেকে বন্দরের বাংলাদেশ অংশে দাঁড়িয়ে ছিলেন বগুড়ার নোমান খান। ঠিক ১৫ মিনিট পর অটোরিকশাযোগে ভারত-বাংলাদেশ জিরো পয়েন্টে ব্যাগ-লাগেজ নিয়ে এসে দাঁড়ান এক তরুণী। দ্রুত এগিয়ে নোমান ওই তরুণীর ব্যাগ-লাগেজ হাতে নেন।
নোমান জানান, তার স্ত্রীর নাম ইশানা রায় চৌধুরী। ভারতের দার্জিলিংয়ে স্ত্রীর বাড়ি। প্রেম করে বিয়ে করেন তারা। স্ত্রী ইশানা দুপুরে খেয়ে রওনা দেন। অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছে যান। দুজনের বাড়ি দুই বাংলায় হলেও মাসে কয়েকবার তারা এ বন্দর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশে সহজে যাতায়াত করেন। স্থল বন্দরটির কারণে দুই বাংলার ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়েছে।
শনিবার বিকেলে পঞ্চগড় সদরে কথা হলে ষাটোর্ধ্ব বয়সী জালাল বলেন, আগে এই এলাকার রাস্তাঘাট এমন ভালো ছিল না। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ও পঞ্চগড়ে নতুন ট্রেন আসার পর এ এলাকার রাস্তাঘাট বদলে গেছে। নতুন রূপ পেয়েছে সবকিছু।
এদিকে, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ঘিরে পাথরের ব্যবসাও বেড়েছে। স্থলবন্দরটি হয়ে সবচেয় বেশি যে পণ্য আসে সেটিও পাথর। আর এই পাথরভাঙা শিল্পকে কেন্দ্র করে বেড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান।
পাথর ব্যবসায়ী লোকমান জানান, আগে বুড়িমারী বন্দর দিয়ে পাথর নিয়ে আসতেন। এখন এই পথ দিয়ে সহজে ও অল্প খরচে প্রতি মাসে ৩০ হাজার সেফটি পাথর আমদানি করেন। বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর হওয়ার কারণে যাতায়াতে অনেক সুবিধা হচ্ছে। এই বন্দরের রাস্তাগুলো অনেক ভালো, গাড়িতে মালামাল লোড করতেও সুবিধা হয়।
বাংলাবান্ধা বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলায় অবস্থিত বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরটি দেশের একমাত্র চতুদের্শীয় স্থলবন্দর। এই বন্দর দিয়ে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আমদানি-রফতানির কার্যক্রম চলছে। ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় স্থলবন্দরটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। পণ্য অমদানির পাশাপাশি দেশীয় পণ্য রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন এ স্থলবন্দরে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক কাজ করে। জীবিকা নির্বাহে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষাভাবে এই বন্দরের সঙ্গে যুক্ত।
বন্দর কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছে, নেপালের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার্থে ১৯৯৭ সালে বন্দরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ২০১১ সালে ভারতের সঙ্গে এবং ২০১৭ সালে ভুটানের সঙ্গে এই বন্দরে পণ্য আমদানি-রফতানি কার্যক্রম শুরু হয়। এ বন্দরের মাধ্যমে ভারত থেকে পাথর, ভুট্টা, খৈল, আদা, গম, চাল, ফল এবং নেপাল ও ভুটান থেকে উৎপাদিত ও বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত পণ্য আমদানি করা হয়।
এ ছাড়াও দেশ থেকে পার্টস, গ্লাস শিট, ওষুধ, আলু, জুস, কর্টন ব্যাগ ও খাদ্যসামগ্রী রফতানি করা হয়। বর্তমানে এ বন্দরের কলেবর আরও ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এটিকে আধুনিক বন্দরে রূপান্তরের জন্য মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করে বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য থেকে আরও জানা গেছে, এই বন্দর দিয়ে প্রতিবছরই আমদানি-রফতানি ক্রমাগত বেড়ে চলছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৬৫৬ টন পণ্য এবং রফতানি হয়েছে ৭ হাজার ৫১ টন পণ্য। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ১২ লাখ ৭ হাজার ৩২৩ টন ও রফতানি ৬৯ হাজার ২০৫ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি ১৭ লাখ ৯৬ হাজার ৮৬৯ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি ১১ লাখ ৮৬ হাজার ৫৮ টন ও রফতানি ১ লাখ ১৩ হাজার ৩৯০ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি ১৬ লাখ ৯৩ হাজার ১২০ টন ও রফতানি ১ লাখ ১১ হাজার ৫৬৯ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ৭২৬ টন ও রফতানি হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৭৫ টন পণ্য।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বন্দরটির প্রধান সুবিধা হলো চার দেশকে সংযুক্ত করেছে। এর ফলে পঞ্চগড়ের হাইওয়ে রোডটি এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে মিলেছে। এই বন্দর দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে বেশি আমদানি করা হয় পাথর। আমাদের দেশ থেকে খাদ্য সামগ্রীসহ পাট, জুট, গ্লাস, ওষুধ বেশি রফতানি করা হয়। আর আমদানিকৃত বেশির ভাগ পণ্য আসে নেপাল থেকে। এই পথে দৈনিক প্রায় সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ ট্রাক আমদানি পণ্য আনা হয়, আর ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষ যাতায়াত করে। এই বন্দর থেকে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তা প্রতি অর্থবছরেই শতভাগ অর্জিত হয়।’
তিনি বলেন, ‘গত ১৪ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাবান্ধা বন্দরে অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হয়েছে। এখানে কিছুদিন আগেও তেমন কিছু ছিল না বললেই চলে।’
প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরাসরি নেপাল পর্যন্ত আমাদের ট্রানজিট ব্যবস্থা না থাকায় পণ্য রফতানিতে বেগ পেতে হয়।’
বন্দরের ভবিষ্যত পরিকল্পনা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বন্দরটি সাড়ে ১০ একর জমির ওপর অবস্থিত। আরও সাড়ে ১৬ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। কাজ শেষ হলে বন্দরটি ২৭ একরের বন্দরে পরিণত হবে।’
জানতে চাইলে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। আমদানি-রফতানির ব্যয় কমিয়েছে। এর ফলে আসলে দূরত্ব-ই কমে গেছে। এটি এশিয়ান হাইওয়ে-২ এর সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে। সব যায়গার সঙ্গে কানেক্টেড হওয়ার ফলে ব্যবসায়ীরা যেখানে ইচ্ছে সেখানেই পণ্য পাঠাতে পারছেন। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার করতে পারছেন। এ বন্দরের ফলে উত্তরাঞ্চলের সড়ক ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। এই বন্দরটি পুরো উত্তরের জনপদকেই পাল্টে দিয়েছে।’
সারাবাংলা/ইএইচটি/একে