পঞ্চগড়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে এখন রেল
১২ জুলাই ২০২৩ ১০:০০
পঞ্চগড় থেকে ফিরে: কয়েকবছর আগেও পঞ্চগড়ের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ ছিল না। অন্য জেলার সঙ্গেও ছিল না আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস। ২০১৮ সালের শেষ দিকে দেশের সর্বোচ্চ দুরত্বের ঢাকা-পঞ্চগড়-ঢাকা রেলপথে আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালু হয়। ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ে এখন তিনটি আন্তঃনগর ট্রেন চলছে। পঞ্চগড় থেকে রাজশাহী ও সান্তাহারে চলছে আরও দুটি আন্তঃনগর ট্রেন।
আধুনিক হয়েছে পঞ্চগড়ের রেলস্টেশনও। এমন দৃষ্টিনন্দন স্টেশন সাধারণত অন্য জেলায় দেখা যায় না। ঢাকা কিংবা অন্য জেলার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে পঞ্চগড়ের মানুষের প্রিয় বাহন এখন ট্রেন। এই পথের বিভিন্ন স্টেশন ও ট্রেনে মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। ৬৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথেও মানুষকে ট্রেনে দাঁড়িয়ে যাতায়ত করতে দেখা গেছে। ঈদ ও অন্যান্য উৎসবে এই পথে চলাচলকারী যাত্রীরা ট্রেনের ছাদেও উঠে পড়েন। রেলের জনপ্রিয়তায় যাত্রী কমেছে বাসেরও। সবমিলিয়ে পঞ্চগড়ে এখন ট্রেনের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। পঞ্চগড়সহ এই রেলপথ ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
ঢাকায় বেসরকারি চাকরি করেন পঞ্চগড়ের বাসিন্দা নূরে আলম। দুই তিন মাস পর পর পঞ্চগড় থেকে ঢাকায় ট্রেনে যাওয়া-আসা করেন তিনি। গত শনিবার (৮ জুলাই) পঞ্চগড় স্টেশনে কথা হলে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এয়ারপোর্টের কাছেই আমার অফিস। দুই তিন মাস পর পর বাড়িতে আসি। কিন্তু যাওয়া আসার পথে ট্রেনের টিকেট পাই না। তবে ট্রেনের ভেতরে থাকা লোকদের কিছু টাকা দিলে তারা আসনের ব্যবস্থা করে দেয়। অথচ আমরা টাকা দিয়ে আসনযুক্ত সিট পাই না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক সময় বাসে চলাচল করতাম। বাসে যেতে কখনও কখনও ১৩ থেকে ১৪ ঘণ্টা লেগে যেতো। ট্রেনে যেতে এখন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লাগে। আর বাসের চেয়ে ট্রেনে সব দিক থেকেই আরাম। এই দীর্ঘ পথে টয়লেট বা বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। বাসে সেই সুবিধা নেই, কিন্তু ট্রেনে আছে। তাই পঞ্চগড়বাসীর কাছে ট্রেন এখন অনেক জনপ্রিয়।
পঞ্চগড় রেলস্টেশন এলাকার বাসিন্দা মো. জালাল (৬০)। কথা হলে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ঢাকা কিংবা অন্য কোনো জায়গায় যেতে আগে দিনাজপুরে গিয়ে ট্রেনে উঠতে হতো। এখন পঞ্চগড় থেকেই সব ট্রেন চলছে। বাসে করে ঢাকা যেতে এখনও ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা লাগে। আর বাসের ভাড়াও বেশি। ফলে মানুষ ট্রেনে বেশি ওঠে।’
গত শুক্রবার (৭ জুলাই) এই প্রতিবেদক একতা এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়ে ঢাকা থেকে পঞ্চগড় যান, একই ট্রেনে করে ফেরেন সোমবার (১০ জুলাই)। শুক্রবার এই ট্রেনটি সকাল ১০ টা ১০ মিনিটে কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। তবে ঈদের কারণে ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী থাকায় ট্রেনটি ঢাকায় পৌঁছাতে বেশ বিলম্ব হয়। সেদিন কমলাপুর স্টেশনের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, ঈদের পর গত শুক্রবার থেকেই গার্মেন্টস কর্মীরা উত্তরাঞ্চল থেকে ফিরতে শুরু করেন। ফলে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে ট্রেনটি চালিয়ে আনতে বেগ পোহাতে হচ্ছিল চালকের। সেদিন দুপুর ২ টায় ট্রেনটি কমলাপুর থেকে ছেড়ে যায়। আনুমানিক রাত সাড়ে তিনটায় ট্রেনটি পঞ্চগড়ে পৌঁছায়। এই দীর্ঘ ট্রেন যাত্রায় দেখা গেছে, প্রতিটি বগিতে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। স্বল্প দূরত্বের যাত্রী যেমন ছিল, ছিল সর্বশেষ স্টেশন পঞ্চগড়ের যাত্রীও। তবে ফেরার পথে রোববার (৯ জুলাই) রাতে ট্রেন ছাড়ে রাত ৯ টা ১০ মিনিটে। পঞ্চগড় থেকে ফেরার পথে ঠাকুরগাঁওসহ অন্যান্য প্রতিটি স্টেশন থেকেই প্রচুর যাত্রী উঠতে দেখা যায়। বগিগুলোতে অকেকটা তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।
আরও পড়ুন: বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর: পাল্টে গেছে উত্তরের জনপদ
পঞ্চগড় রেলওয়ে স্টেশনের তথ্যমতে, পঞ্চগড় থেকে ঢাকায় তিনটি আন্তঃনগর ট্রেন- দ্রুতযান, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ও একতা এক্সপ্রেস চলাচল করছে। পঞ্চগড়-রাজশাহী রেলপথে চলাচল করছে বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস। আর পঞ্চগড় থেকে সান্তাহারে চলাচল করে দোলনচাপা এক্সপ্রেস। অর্থাৎ পঞ্চগড় থেকে পাঁচটি আন্তঃনগর ট্রেন দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলাচল করে। এর বাইরে কাঞ্চন কমিউটার নামে একটি মেইল ট্রেন পঞ্চগড় থেকে পার্বতীপুরে চালু রয়েছে।
জানা গেছে, আগে দ্রুতযান ও একতা এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত চলাচল করতো। ২০১৮ সালে পঞ্চগড় পর্যন্ত আন্ত:নগর ট্রেন যোগাযোগ চালু হয়। আর পঞ্চগড় এক্সপ্রেস নতুন করে চালু করা হয়েছে। বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেসও চালু হয়েছে সম্প্রতি। দোলনচাপা এক্সপ্রেস ট্রেনও এই রেলপথে নতুন। এক সময় কেবলমাত্র একটি ট্রেন পঞ্চগড় স্টেশন থেকে চলাচল করতো।
আরও জানা যায়, দিনাজপুর পর্যন্ত যখন আন্ত:নগর এক্সপ্রেস চলাচল করতো, তখন পঞ্চগড় থেকে শাটল ট্রেন সার্ভিস চালু ছিলো। অর্থাৎ পঞ্চগড় থেকে দ্রুতযান ও একতা এক্সপ্রেসের টিকেট কাটা যেতো। আর সেইসব যাত্রীদের একটি ট্রেনে করে দিনাজপুর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হতো। সেখান থেকে তারা দ্রুতযান ও একতা এক্সপ্রেসে করে গন্তব্যে পৌঁছাতো। এতে এক ট্রেন থেকে আরেক ট্রেনে করে ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে চলাচলে বেশ ঝক্কি-ঝামেলা ছিলো। আরও জানা গেছে, ২০১৮ সালের নভেম্বরে পঞ্চগড়-ঢাকা-পঞ্চগড় সরাসরি আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালু করা হয়। দ্রুতযান ও একতা এক্সপ্রেস দিয়ে এই সার্ভিস চালু হওয়ার পর ২০১৯ সালে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস নামের নতুন ট্রেন চালু করা হয় এই পথে। সেই সঙ্গে পঞ্চগড় স্টেশনের নতুন নাম দেওয়া হয় ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রেলওয়ে স্টেশন পঞ্চগড়’। বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধকালীন ৬ নং সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের ভাই।
বাসের চেয়ে ট্রেনই জনপ্রিয়: পঞ্চগড় থেকে ঢাকায় যাওয়া-আসার পথে বাসের চেয়ে ট্রেনই জনপ্রিয়। সাধারণ মানুষের মতো সেই তথ্য স্বীকার করেছে পরিবহন মালিকরাও। ট্রেনের কারণে ব্যবসা হারাচ্ছেন বলেও মন্তব্য পরিবহন মালিকদের। পঞ্চগড় বাস মিনি বাস সমিতির রোড সেক্রেটারি ফজলে করিম দোলাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘জ্বালানিসহ সব কিছুর দাম বাড়ায় বাসের ভাড়া বেড়েছে। বিপরীতে ট্রেনের ভাড়া বাড়ায়নি। পঞ্চগড় থেকে ঢাকায় ট্রেনে যেতে (নন-এসি) ৫৫০ টাকা ভাড়া, সেখানে বাসে ১০৫০ টাকা। দলে দলে লোক ট্রেনে চলে যাচ্ছে। আমরা যাত্রী পাই না। পঞ্চগড়ে ট্রেনের সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে। এতে পরিবহন মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’
পঞ্চগড় জেলার অভ্যন্তরে চলাচলকারী রিশাদ পরিবহহের মালিক মুনতাসির কায়সার রিশাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘পঞ্চগড়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। আগে পঞ্চগড়ে লোকাল বাস ছিল ৯০ টি, এখন ১৪০ টি। রোড ভালো হওয়ায় আমরা এখন ৫২ সিটের গাড়ি চালাতে পারছি, আগে ৩২ সিটের বাস চালাতে হতো। তবে ট্রেনের সঙ্গে বাস পেরে উঠছে না। এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে ট্রেনের। কারণ রেলমন্ত্রীর বাড়ি এ এলাকায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকায় বাসে যেতে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কিংবা কখনও কখনও ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা লেগে যায়। আর ট্রেনে যেতে ১২ ঘণ্টার মতো লাগে। যেহেতু ট্রেনে যেতে সময় ও টাকা দুটিই কম লাগে, তাই বেশিরভাগ মানুষ ট্রেনেই যাতায়ত করেন।’
পঞ্চগড় রেলস্টেশনের স্টেশন মাষ্টার মো. মাসুদ পারভেজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা থেকে পঞ্চগড় রেলপথে বিভিন্ন আন্ত:নগর ট্রেনে আসনের সংখ্যা ২৫০ টি। প্রতিদিন অন্তত ১ হাজার যাত্রী এই রেলপথে চলাচল করে। এখানে শতভাগ টিকেট বিক্রি হয়। প্রতিমাসে গড়ে ১ কোটি টাকার টিকেট বিক্রি হচ্ছে। আমরা সবাইকে টিকেট দিতে পারি না।’
তিনি আরও বলেন, পঞ্চগড় থেকে ঢাকার এসি বাথের টিকেট মূল্য ১৯৪২ টাকা, এসি চেয়ার ১০৫৩ টাকা, এসি সিট ১২৬০ ও শোভন চেয়ার ৫৫০ টাকা। বিপরীতে পঞ্চগড় থেকে এসি বাসের টিকেট ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকা ও নন এসি বাসের টিকেট ১ হাজার টাকা। যে কারণে পঞ্চগড় থেকে ঢাকায় যেতে বেশিরভাগ মানুষ ট্রেনকেই বেছে নেন।
স্টেশন ম্যানেজার (ঢাকা) মোহাম্মদ মাসুদ সারোয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘পঞ্চগড় থেকে ছেড়ে আসা তিনটি ট্রেনেই যাত্রীদের প্রচুর চাপ থাকে। ঈদের সময় ট্রেনগুলোতে কখনও কখনও যাত্রীরা ছাদেও চড়ে বসে। বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব, বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম ও নাটোর থেকে তাদের নামানোর চেষ্টা করা হয়। এবং কখনও কখনও নামিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ ঢাকা-পঞ্চগড়-ঢাকা রেলপথে প্রচুর যাত্রীর চাপ রয়েছে। প্রতিদিন আনুমানিক ১০ হাজার যাত্রী এই রেলপথে চলাচল করেন।’
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘পঞ্চগড় জেলার যে কয়েকটি সেক্টরের অভূতপূর্ব এবং স্মরণীয় পর্যায়ে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তার মধ্যে রেলওয়ে যোগাযোগ খাত অন্যতম। এ জেলায় রেল ট্র্যাক নির্মাণ, রেল যোগাযোগে নতুন কোচ চালুকরণ, আধুনিক রেলওয়ে প্লাটফর্ম নির্মাণ- বিগত ২০ বছরে আমূল পরিবর্তন সংগঠিত হয়েছে।’
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘আন্তঃজেলা যোগাযোগে পঞ্চগড়ের মানুষের কাছে ট্রেন এখন বেশ জনপ্রিয়। মানুষ ট্রেনকে সবচেয়ে বেশি বেছে নেয়। কারণ ট্রেন জার্নি আরামদায়ক এবং পঞ্চগড় থেকে দেশের অন্যান্য এলাকায় যাওয়ার জন্য এখন ট্রেন এভেইলএবল। পঞ্চগড় থেকে নতুন নতুন ট্রেন সার্ভিস চালু হয়েছে। আগে তো এখান থেকে আন্তঃনগর ট্রেন চলত না। এই এলাকায় ট্রেনের সবচেয়ে বেশি উন্নয়নও হয়েছে।’
সারাবাংলা/ইএইচটি/একে