ঢাকা: ‘মা এখনও স্বাভাবিক হতে পারেননি। ওর (সানি) ছবি নিয়ে বসে থাকে। ওর রুমে গিয়ে ড্রয়ারে থাকা কাপড়গুলো হাতে নিয়ে কান্নাকাটি করে। খাওয়া-দাওয়া করে না বললেই চলে। আর ও যেই খাবারগুলো পচ্ছন্দ করতো এখন আর সেগুলো খান না মা।’
এভাবেই বলছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী তারিকুজ্জামান সানির বড় ভাই মো. হাসানুজ্জামান।
তিনি বলেন, গত বছর ১৪ জুলাই মৈনট ঘাটে ১৫ বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে সানি লাশ হয়ে ফিরে আসার পর থেকে মা কথা বলা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন। সবসময় মনমরা হয়ে বসে থাকেন। কতদিন হয়েছে মায়ের মুখে হাসি দেখি না।
তারিকুজ্জামান সানি ২০২২সালের ১৪ জুলাই ঢাকা জেলার দোহার থানাধীন মৈনট ঘাটে ১৫ বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। পরেরদিন বেলা ১১টা ২৬ মিনিটে মৈনট ঘাট থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সানির বড় ভাই হাসাদুজ্জামান বাদী হয়ে ১৫ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এদিকে সানিকে হত্যা করা হয়েছে নাকি সে দুর্ঘটনায় মারা গেছে তা জানা যায়নি এক বছরেও। তবে আসামিপক্ষের স্বজনরা বলছেন, এটা হত্যা নয়, দুর্ঘটনা। পুলিশ বলছে, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলেই জানা যাবে প্রকৃত ঘটনা।
বর্তমানে মামলাটি তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। সর্বশেষ গত ২৬ জুন মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিন পুলিশ প্রতিবেন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এম সাইফুল ইসলামের আদালত আগামী ২৭ জুলাই প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন। মামলার ১৫ আসামি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে পেয়েছেন।
ছোট ভাই সানির মৃত্যুর কথা স্মৃতিচারণে করে হাসানুজ্জামান বলেন, তিন বছর আগে বাবাকে হারিয়েছি। সেই শোক কাটতে না কাটতে ভাইটাকেও হারালাম। সানির মৃত্যুর শোক মা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আসলে যার যায় সে বোঝে।
তিনি বলেন, সানি আমাদের স্বপ্ন ছিল। ও আমাদের জন্য কিছু করবে এটা নয় বরং ওর জন্য কিছু করতে পারিনি এটা ভেবেই কষ্ট লাগে। স্বপ্ন ছিলো বুয়েট থেকে পাশ করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য জার্মানিতে যাবে। ফাইনাল সেমিস্টার শেষ করে মাস্টার্সে পড়াশোনার জন্য জার্মানি পাঠাব। যাই হোক সেটা তো আর হলো না, স্বপ্নই থেকে গেল। সানির বই খাতা, পড়ার টেবিল সব আগের মত আছে শুধু ও নেই।
হাসানুজ্জামান বলেন, গত ৮ মে সানির জন্মদিন ছিল। কোনো কিছুই করা হয়নি। মানুষ না থাকলে তো আর কিছুই থাকে না, জন্মদিন কি আর মৃত্যুদিন কি? আমাদের কাছে প্রতিদিনই সানির মৃত্যুর দিন। কারণ ও তো আর নেই, ওর ঘরের জিনিসপত্র গুলো সব আছে। জিনিসপত্র দেখে মনে হয় সানি ছিল, এখন আর নেই। তবে সানির মৃত্যুর বিষয়টা সন্দেহজনক। কয়েকজন বলেছে সানিকে খেয়াল করেনি। আবার কয়েকজন বলছে, সানি পড়ে গেলে তাকে তারা সাহায্য করতে যান। ১৫ জনের ৩০টা হাত। চাইলেই সানিকে বাঁচাতে পারতো। আমরা চাই আসল অপরাধী সবার সামনে আসুক। প্রকৃত অপরাধীর সাজা হোক, আর নিরাপরাধ যেন মুক্তি পায়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কুতুবপুর নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির এসআই জহুরুল ইসলাম বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। এটি একটি আলোচিত মামলা। সময় নিয়ে, গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে। অন্যান্য সংস্থাও ছায়া তদন্ত করছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি। রিপোর্ট পাওয়ার পর জানা যাবে আসল ঘটনা।
তিনি বলেন, তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। ঘটনা উদঘাটন করে আমরা বিষয়টি সবাইকে জানাব।
উল্লেখ্য, ২০২২সালের ১৪ জুলাই ঢাকা জেলার দোহার থানাধীন মৈনট ঘাটে ১৫ বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে নিখোঁজ হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী তারিকুজ্জামান সানি। নিখোঁজ হওয়ার পর সানির সন্ধানে নামে ফায়ার সার্ভিসের থেকে ডুবুরি দল। ওইদিন রাতে রাতে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে শুক্রবার বেলা ১১টা ২৬ মিনিটে মৈনট ঘাট থেকে সানির মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় গত ১৫ জুলাই বিকেলে সানির বড় ভাই হাসাদুজ্জামান একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ১০। ওই মামলায় আসামি করা হয় সানির সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া অন্য ১৫ বন্ধুকে।
মামলার ১৫ আসামি হলেন-শরীফুল হোসেন, শাকিল আহম্মেদ, সেজান আহম্মেদ, রুবেল, সজীব, নুরজামান, নাসির, মারুফ, আশরাফুল আলম, জাহাঙ্গীর হোসেন লিটন, নোমান, জাহিদ, এটিএম শাহরিয়ার মোমিন, মারুফুল হক মারুফ ও রোকনুজ্জামান ওরফে জিতু।