জুলাইয়ের ১৫ দিনেই জুনের দ্বিগুণ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে
১৬ জুলাই ২০২৩ ১০:৩১
ঢাকা: চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে— এমন আশঙ্কা ছিল বছরের শুরু থেকেই। সেই আশঙ্কা বাস্তবতায় রূপ নিয়ে দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। প্রতিদিনই এখন সংখ্যা বিবেচনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগের দিনের পরিসংখ্যান। প্রায় সারাদেশেই এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রোগীরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ১৫ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৪৭৬ জন, যা জুন মাসে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যার (পাঁচ হাজার ৯৫৬ জন) প্রায় দ্বিগুণ।
শুধু তাই না, জুলাই মাসের প্রথম ১৫ দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও ছাড়িয়ে গেছে বছরের প্রথম ছয় মাসের পরিসংখ্যান। জুন মাস পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ৪৭ জন। যেখানে জুলাই মাসের প্রথম ১৫ দিনে মারা গেছেন ৫৩ জন।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, এবার নানা কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অপরিকল্পিত মশা নিধন কর্মসূচির পাশাপাশি সমন্বয়হীনতার কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে একাধিক ধরণ শনাক্ত হওয়া।
মৌসুমের শুরু থেকেই গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদদের।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি কী?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, ১৫ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৯ হাজার ৪৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মাঝে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৩ হাজার ১০৯ জন।
ঢাকা মহানগরীর বাইরে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন পাঁচ হাজার ১৪২ জন।
এর মাঝে শুধুমাত্র জুলাই মাসের প্রথম ১৫ দিনে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ১১ হাজার ৪৭৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন।
এর আগে, জুন মাসে চলতি বছরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ৯৫৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ১৬৬ জন, মার্চ মাসে ১১১ জন, এপ্রিল মাসে ১৪৩ জন ও মে মাসে এক হাজার ৪৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
দেশে জুন মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন সাত হাজার ৯৭৮ জন। কিন্তু জুলাই মাসে প্রথম ১৫ দিনেই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৪৭৬ জন।
বেড়েছে মৃত্যুসংখ্যাও
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৫ জুলাই পর্যন্ত মারা গেছেন ১০০ জন। এর মাঝে শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে মারা গেছেন ৭৮ জন। বাকি ২২ জনের মাঝে সর্বোচ্চ ১৩ জন মারা গেছেন চট্টগ্রাম বিভাগে।
এছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগে তিনজন, খুলনা বিভাগে দুই জন, রাজশাহী বিভাগে দুই জন, রংপুর বিভাগে একজন, বরিশাল বিভাগে একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন। সিলেট বিভাগে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
দেশে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৪৭ জন। এর মাঝে জানুয়ারি মাসে ছয় জন, ফেব্রুয়ারি মাসে তিন জন, এপ্রিল মাসে দুই জন, মে মাসে দুই জন মারা গেলেও জুন মাসে ৩৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তবে জুলাই মাসের প্রথম ১৫ দিনেই ছাড়িয়ে গেছে সেই সব পরিসংখ্যান। এই ১৫ দিনে দেশে ৫৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে
চলতি মৌসুমে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার একাধিক জরিপে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর ঢাকা শহরের ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা বেশি।
তবে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, ডেঙ্গু এখন শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরে সীমাবদ্ধ নেই। বলা যায় প্রায় সারা দেশেই এডিস মশা এখন বংশ বিস্তার করছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় সারাদেশেই আমরা এডিস মশার অস্তিত্ব পেয়েছি জরিপ চালিয়ে। এক্ষেত্রে বলা যায় ডেঙ্গু এখন আর কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকা, থানা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, জেলা বা বিভাগে সীমাবদ্ধ নেই। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বেশি। একইভাবে মৃত্যুর সংখ্যাও এবার বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে বছরের শুরু থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। তবে রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের দিকে সংক্রমণের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার সারাবাংলাকে বলেন, ‘হটস্পট ব্যবস্থায় ব্যর্থ হওয়ার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগী যেসব এলাকা থেকে বেশি আসে, সেখানে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন। দরকার হলে সেখানে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। তা হলে এক রোগী থেকে অন্য রোগী আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। যদি এমনটা না হয় তবে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না।’
তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। বাসা বাড়ি বা আশপাশে যেন পানি জমা না থাকে, পানি জমার মতো কোনো পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়, কোথাও যেন পরিত্যক্ত টায়ার বা কোনো ধরনের পাত্র পড়ে না থাকে, এই বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’
সমাধান কী?
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. বেনজীর আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু যে দেশে ঢোকে, সেখান থেকে বের হয় না। কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের দেশে দুই যুগের বেশি সময় ধরে এর নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ করা হয়নি। ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলেও এর নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। আর তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি একটি সঠিক কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘দেশে ডেঙ্গুর একাধিক ধরন ছড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন। তবে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এই মুহূর্তে মশক নিধন করা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। মশক নিধন কর্মসূচির পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারিভাবে প্রচার-প্রচারণা জোরদার করা দরকার, যাতে মানুষ সচেতন হয়।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, ডেঙ্গু যখন কোনো কমিউনিটিতে প্রবেশ করে, তখন তাকে একেবারে নির্মূল করা যায় না। যেহেতু সামনে আরও নগরায়ণ হবে, আরো উন্নয়ন হবে, আমাদের আগেভাগে মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।’
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রভাব বাড়ছে। এই সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে হলে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবাইকে নজর রাখতে হবে যে, বাসাবাড়ির ছাদ ও আঙিনায় যেন পানি জমে না থাকে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশার কামড় থেকে মুক্ত থাকতে হবে।’
সারাবাংলা/এসবি/এমও