।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালের তিন তলার একটি ওয়ার্ড। সারিবদ্ধ বিছানায় শুয়ে আছে ছোট ছোট শিশুরা। বিছানার পাশে রাখা স্ট্যান্ড থেকে রক্ত যাচ্ছে তাদের শরীরে। তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল টেলিভিশনে চলা কার্টুন। এদের মধ্যে কেউ পাশে থাকা মা বা নানুর সঙ্গে গল্প করছিল। রুমটির একেবারে শেষের দিকের একটি বিছানায় বসে রক্ত নিচ্ছিলো সাদা টি-শার্ট পরা এক শিশু। পাশাপাশি কিছু একটা খাচ্ছিলো সে। পাশেই তার মা বসে। আলাপ করে জানা গেল, তার নাম তৌসিফ।
মাত্র ৭ বছরের তৌসিফ থ্যালাসেমিয়ার সঙ্গে লড়ছে আড়াই বছর ধরে। সঙ্গে লড়ছে তার পরিবারও। বিছানার ওপর বসে একটি প্লেটে সিঙ্গারা ভেঙে ছেলেকে দিচ্ছিলেন শাহিদা বেগম। এ সময় সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
সারাবাংলাকে তিনি জানান, জীবনের প্রয়োজনে তৌসিফকে নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। এত কম বয়সে এত কঠিন পরীক্ষায় প্রতিনিয়ত উত্তীর্ণ হতে হয় তাকে। মাঝে মাঝে সে আর তার পরিবার পেরে ওঠে না, তাদের কষ্ট হয়, যন্ত্রণা হয়। তবুও তারা নিরবে সব সহ্য করে জীবনের প্রয়োজনে।
শাহিদা বেগম বলেন, ‘সেই ছোট বেলা থেকেই এই যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যুদ্ধটা আমাদের। শুধু ওর একার নয়। যুদ্ধ করছে করুক কিন্তু তারপরও ছেলেটা বেঁচে থাকুক।’
সময় মতো রক্ত দেওয়া না গেলে তৌসিফের পুরো শরীর হলুদ হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, ‘সারাক্ষণ ভয়ের মধ্যে থাকি। কখন যেন কী হয়ে যায়। রক্ত না দিতে পারলে পুরো শরীর হলুদ হয়ে যায়, দুর্বল হয়ে পরে, কিছু খেতে চায় না, শুয়ে থাকে, অস্থির লাগে ভেতরে- ভয় লাগে।’
ছেলের কষ্টে ভীষণ কষ্ট হয় তাদের। তিনি বলেন, ‘ওর থেকে ভয় আমার বেশি লাগে- মনে হয়, ওর না জানি কতোটা খারাপ লাগছে, ওর ভেতরে কতটা কষ্ট হচ্ছে।’ ছেলের কষ্টের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তিনি।
সারাবাংলার সঙ্গে কথা কথোপকথনের সময় বারবার চোখ মুছছিলেন শাহিদা। এক পর্যায়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন। কান্নায় ভেঙে পড়েন শাহিদা বেগম।
এদিকে মায়ের কান্না দেখে বিছানার পাশে থাকা তৌসিফের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ। সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, তার কী করা উচিৎ। তার শারীরিক জটিলতার কারণে পরিবারের যে বর্তমান অবস্থা, সে বিষয়টি পুরোপুরি বোঝার বয়সও তার হয়নি। সে শুধু একবার তার মায়ের দিকে তাকায়, আরেকবার এই প্রতিবেদকের দিকে তাকায়। এরপর মাথা নিচু করে থাকে সে।
মায়ের কান্না দেখে দেখে তৌসিফ এখন অভ্যস্ত। কিছুক্ষণ পর নিজের ডান হাত বাড়িয়ে যতোটা পারা যায় মাকে জড়িয়ে ধরে সে।
এর মাঝে চোখ মোছেন শাহিদা। একটু স্বাভাবিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। তারপর বলেন, ‘ওর কষ্টটা অনুভব করার চেষ্টা করি। বাচ্চা মানুষ হয়তো বলতে পারছে না- এই কষ্টটা আমি মা হয়ে সহ্য করতে পারি না। নিজেকে বোঝাই, যদি আল্লাহর নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকতো, তাহলে হয়তো আরও আগেই নিয়ে যেত। এতো বড় রোগ দিয়ে এতদিন বাঁচিয়ে রাখতো না। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ঘরে এমন সন্তানের জন্ম’ এতটুকু বলে আবারও শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চোখ মোছেন তিনি।
থ্যালাসেমিয়া সঙ্গে যুদ্ধ করতে যে অর্থনৈতিক শক্তির দরকার- তা শাহিদা বেগমের পরিবারের নেই। এসব বিষয় নিয়ে দুঃখ ও আফসোস করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আবার ওর চাহিদা মতো খাবার খেলে আয়রন জমে যায়, তখন শরীরে অনেক সমস্যা হয়। তখন আবার সেই আয়রন শরীর থেকে ফেলতে হয় ওষুধ খেয়ে।’
“ছেলেটা মাংস, ডিমের কুসুম, মাছ খেতে চায় কিন্তু এসব খাবারতো ও খেতে পারবে না। ওর সামনে তাই মাংস খেতে পারি না, দুধ চা-ডিম খাওয়া আমিতো ছেড়েই দিয়েছি, মা হয়ে আমি কেমন করে খাই।”
তাহলে কী খাওয়াবো, কিভাবে বাঁচিয়ে রাখব ওকে! এবার তিনি ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন।
শত প্রতিকূলতা এবং জটিলতার মধ্যেও তৌসিফ বাঁচবে- এইটুকুই চাওয়া। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় চিন্তা করি, ছেলেটার জন্য কী করতে পারি, কী করলে ছেলেটাকে বাঁচায়ে রাখতে পারব- এটা একটা যুদ্ধ আমাদের। কেবল আমরা না, এতোটুকুন ছেলেটাও সমান যুদ্ধ করছে।’
‘মাসটা শেষ হলেই টেনশনে পরি, ছেলেটাকে রক্ত দিতে হবে, বাঁচিয়েতো রাখতে হবে। তৌসিফ সমান যুদ্ধ করছে- তবুও চাই যুদ্ধ করছে করুক, কিন্তু বেঁচে থাকুক।’
আড়াই বছর বয়স থেকে নিয়মিত থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতাল যাতায়াত করতে হয় তার। বেশির ভাগ কাজ তিনিই করেন। ছোট বেলায় একটি পা বাঁকা ছিল তৌসিফের। সে চিকিৎসা তাকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রক্ত দেওয়ার পুরোটা সময় একাই তৌসিফের যাতায়াত করেছে তার মা। স্বামী সময় দিতে পারেন না। কারণ রাজধানীর টিকাটুলিতে একটি দোকান চালান তিনি। ছেলের চিকিৎসার বাড়তি টাকা জোগাড়ের জন্য ছুটির দিনেও দোকান খোলা রাখতে হয়। এভাবে স্বামী-স্ত্রী মিলে চলছে সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার এক অবিরাম যুদ্ধ।
বোনম্যারো ট্রান্সফার করার বিষয়ে ভেবেছেন তারা। কিন্তু এত খরচ করার সামর্থ তাদের নেই।
তিনমাস পর রক্ত দিলে শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। শাহিদা বলেন, ‘এবার এসেছি দুই মাস পর। কিন্তু চিকিৎসকরাতো বলেন, প্রতিমাসে রক্ত দেওয়ার কথা। কিন্তু টাকার সমস্যার কারণে পারি না।’
রক্তের অপ্রতুলতার সঙ্গে অর্থের অভাব। এই দুই মিলে যুদ্ধটাকে প্রায় অসম্ভব করে ফেলেছে। তারপরও স্বপ্ন দেখেন তারা। ভাবেন কেউ হয়তো একদিন তাদের সহযোগিতা করবে। বেঁচে থাকবে তাদের প্রাণের স্পন্দন তৌসিফ।
সারাবাংলা/জেএ/এমআইএস/এটি
** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে সারাবাংলার ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: Sarabangla/Facebook