ডেঙ্গু ছড়িয়েছে সারাদেশে, পাল্টেছে লক্ষণ-উপসর্গ
১৬ জুলাই ২০২৩ ২৩:৫০
ঢাকা: দেশের ৬৩ জেলার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগী। চলতি মৌসুমে শুধুমাত্র চুয়াডাঙ্গা বাদে বাকি সব জেলাতেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। সিলেট বাদে দেশের অন্য সব বিভাগেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রোগীর মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম।
শুধু তাই নয়, চলতি মৌসুমে বদলে গেছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর লক্ষণ-উপসর্গও। জ্বরের পাশাপাশি বেশি দেখা দিচ্ছে বমি, ডায়রিয়া, পেট ব্যথা ও নিউমোনিয়ার মতো ১৬টি লক্ষণ-উপসর্গ। শরীরে অচেনা উপসর্গ প্রকাশ পাওয়ায় বিভ্রান্ত হচ্ছেন রোগীরা। জ্বর ছাড়া অন্য উপসর্গকে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে দেখা দিচ্ছে জটিলতা। দেশে ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে ডেঙ্গুর একাধিক ধরণ। আর তাই বিপদ এড়াতে শরীরে অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলেই ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ চিকিৎসকদের।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, এবার নানা কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আগে ডেঙ্গু জ্বর হলে তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে ধরণ। যার বিষয়ে নাগরিকদের অনেকেই এখনো সেভাবে সচেতন নন। আর তাই নমুনা পরীক্ষা দেরিতে করাচ্ছে অনেকেই। অনেকে শরীরে ব্যথা অনুভব করে ফার্মেসি থেকে ওষুধ খাচ্ছে। কিন্তু পরে জ্বর আসলেও বুঝতে পারছে না। এর সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তিতেও অনেকের উদাসীনতা কাজ করছে। সময়ক্ষেপণ করে যখন হাসপাতালে আসছেন তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই উপসর্গ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
মৌসুমের শুরু থেকেই গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদদের।
বদলে গেছে ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ-উপসর্গ
রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের বিভিন্ন লক্ষণ ও উপসর্গ। হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ নিয়াতুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক সময় ডেঙ্গুকে বলা হতো হাড়-ভাঙ্গা জ্বর। কিন্তু ডেঙ্গু এখন শুধুমাত্র জ্বর নয়, ১৬টি লক্ষণের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে এই ভাইরাস। জ্বর, বমি, ডায়রিয়া, পেটে ও বুকে পানি জমার লক্ষণ অনেক বেশি। এছাড়া, মাথা ও গলাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা, ফুসকুড়ি, মাড়ি থেকে রক্তপাত, মস্তিষ্কে প্রদাহ ও হঠাৎ রক্তচাপ কমে যাচ্ছে অনেক রোগীর।’
তিনি বলেন, ‘এবার হাসপাতালে এমন অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছেন যারা এ মৌসুমে জ্বরে আক্রান্তই হননি। অর্থাৎ জ্বর না হলেও পরীক্ষার পর তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত বলে জানা গেছে। এই মৌসুমের শুরুর দিকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া একাধিক গুরুতর রোগীর মধ্যে দেখা যায় তাদের কোনো জ্বর নেই। মূলত তারা ডায়রিয়াজনিত রোগে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তী সময়ে পরীক্ষা করে দেখা যায় তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত।’
আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তীব্র গরমের মাঝে অনেকে হালকা জ্বরের বিষয়টি পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এরপরেই দেখা যায় তাদের শরীরে ডেঙ্গুর তীব্রতা বাড়তে থাকে ও পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হয়। আর তাই বিপদ এড়াতে শরীরে অস্বস্তি বা অস্বাভাবিক কোনো অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিলেই ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ ডা. নিয়াতুজ্জামানের।
সারাদেশের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ইতোমধ্যেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জন্য ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে।
ডেঙ্গু চিকিৎসা জাতীয় গাইডলাইনের প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক কাজী তারিকুল ইসলাম বলেছেন, জ্বর ছাড়া অন্যগুলোকে অনেকেই ডেঙ্গুর উপসর্গ মনে করেন না। তাই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়। এবার শরীরে অতিরিক্ত দুর্বলতা, চোখের পেছনে ব্যথা, খিচুনি ও নিউমোনিয়া নিয়েও দেখা দিচ্ছে ডেঙ্গু।
তিনি বলেন, ‘আমরা যেমন নিজেদের বাঁচার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে থাকি, ঠিক তেমনি ভাইরাসও নিজের ধরণ ও লক্ষণ পরিবর্তন করে। আর তাই আমি সবাইকে বলব আগের প্রচলিত যে লক্ষণগুলো ছিল সেগুলো বাদেও নতুন অনেক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সেগুলোও ডেঙ্গুর লক্ষণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি কারো ডায়রিয়া হয় তবে যেন কেউ না ভাবে সেটার জন্য হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার দরকার নেই। অন্য উপসর্গ দেখেও কেউ ভাবতে পারে যে, ডেঙ্গু পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এবার ডেঙ্গুতে ডায়রিয়া অন্যতম একটি উপসর্গ। আর তাই হেলা করার উপায় নেই। শরীরে কোনো অস্বাভাবিক উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, ডেঙ্গু নির্ণয় করার পরীক্ষা করাতে হবে।
যে ১৬টি লক্ষণ এবার বেশি দেখা যাচ্ছে
১. জ্বর
২. বমি
৩. ডায়রিয়া
৪. পেটে পানি জমা
৫. বুকে পানি জমা
৬. মাথা ব্যথা
৭. শরীর ব্যথা
৮. গলা ব্যথা
৯. ফুসকুড়ি
১০. মাড়ি থেকে রক্তপাত
১১. মস্তিষ্কে প্রদাহ
১২. রক্তচাপ কমে যাওয়া
১৩. দুর্বলতা, ক্লান্তি
১৪. চোখের পেছনে ব্যথা
১৫. খিঁচুনি
১৬. নিউমোনিয়া
ডেঙ্গু ছড়িয়েছে ৬৩ জেলায়
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, দেশের ৬২টি জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র চুয়াডাঙ্গা জেলায় কোনো ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়নি।
সক্রিয় ডেঙ্গুর একাধিক ধরণ
দেশে চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের নমুনা বিশ্লেষণ করে একাধিক ধরণের উপস্থিতি মিলেছে। এর মাঝে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গবেষণা বলছে, এবারই প্রথম ডেন-টু ধরনের ডেঙ্গুর বিস্তার বেশি দেখা যাচ্ছে। এ বছরের ডেঙ্গু রোগীদের ৫১ ভাগই ডেন-টুতে আক্রান্ত।
আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন জানান, ডেঙ্গুর সেরোটাইপ বা ধরন চারটি। এবার ডেঙ্গু আক্রান্তদের ধরন জানতে রাজধানীর ৩০০ রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআর। নমুনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৫১ দশমিক ৫ শতাংশের সংক্রমণ ডেন-২–এ এবং ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশের সংক্রমণ ডেন-৩–এ। বাকি ৪ দশমিক ৬ শতাংশ রোগী একই সঙ্গে ডেন-২ ও ডেন-৩–এ আক্রান্ত। ডেন ওয়ান ও ফোরে আক্রান্ত কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি।
একাধিক ধরণ থাকা বিপজ্জনক
ডেঙ্গুর একাধিক ধরন থাকায় চলতি মৌসুমে রোগীর জটিলতা ও মৃত্যু বাড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার মৃত্যুহার বেশি। ডেন টু-তে আক্রান্তদের জটিলতা বেশি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম ও দীর্ঘ মেয়াদি রোগে যারা আক্রান্ত তাদের ঝুঁকি আরও বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-(সিডিসি)এর তথ্যানুযায়ী, ডেঙ্গুর মোট তিনটি পর্যায় আছে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ফেব্রিল ফেইজ বা জ্বর পর্যায়, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ক্রিটিক্যাল ফেইজ বা গুরুতর পর্যায় এবং তৃতীয়টি হচ্ছে কনভালেসেন্ট ফেইজ বা নিরাময় পর্যায়।
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘যত খারাপ রোগী আসে তাদের বেশিরভাগই ক্রিটিক্যাল ফেইজ বা গুরুতর পর্যায়ে চলে যাওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হতে আসে। কারও জ্বর এসে সেটি কমে যাওয়ার পর বমি শুরু হয়। কিন্তু এই বমি কমে না। অনেকের রক্তচাপ খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু সে বুঝতেও পারে না যে, তার রক্তচাপ এতটা কমে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘কেউ যদি একটি বা দু’টি উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় তবে তার আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু যখন অনেকগুলো উপসর্গ এক সাথে থাকে তখন তাকে চিকিৎসার ভাষায় বলা হয়, মাল্টি-অরগান ডিসফাংশন সিনড্রোম। অর্থাৎ তার দেহের একাধিক অঙ্গ তখন আক্রান্ত হয় এবং তাদের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। একাধিক অঙ্গ কাজ করছে না এই ধরণের রোগী আমরা প্রচুর পাচ্ছি। ফলে এই ধরণের রোগীদের আমাদের আইসিইউ সাপোর্ট দিতে হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে চিকিৎসকদের কাছে যে নীতিমালা দেওয়া হয়েছে সেখানে উল্লেখ আছে যে, প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্তদের উপসর্গ প্রথাগত উপসর্গের তুলনায় ভিন্ন হতে পারে। সে কারণে এ ধরণের উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।’
ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘এবার হাসপাতালে যারা ভর্তি হচ্ছেন তাদের মধ্যে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এমন রোগীর সংখ্যা বেশি। তারা হয়তো আগে একটি সেরোটাইপে আক্রান্ত হয়েছিল, কিন্তু এখন অন্য কোনোটিতে। ফলে যে উপসর্গগুলো নিয়ে তারা আসছেন সেগুলো প্রথাগত ডেঙ্গু উপসর্গের মতো নয়। একে বলা হচ্ছে, কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু সিনড্রোম বা এক্সটেনডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম। এই উপসর্গগুলো কোনভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নেই।’
প্রসঙ্গত, চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে- এমন আশঙ্কা ছিল বছরের শুরু থেকেই। সেই আশঙ্কাকে বাস্তবতায় রূপ দিয়ে দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। ১৫ জুলাই পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ২০ হাজারেরও বেশি রোগী। এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ১০৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী গতবছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৮১ জন এবং মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬২ হাজার ৩৮২ জন।
উল্লেখ্য, দেশে প্রথম ডেঙ্গু ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে ২০০০ সালে। এরপর থেকে প্রতিবছরই মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে।
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম