Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভারতের আদলে জুডিসিয়াল একাডেমি প্রতিষ্ঠার পরামর্শ হাইকোর্টের

কামরুল ইসলাম ফকির, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৭ জুলাই ২০২৩ ০৯:৫৪

ঢাকা: বিচারক, আইনজীবী এবং বিচার বিভাগের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের ‘ন্যাশনাল জুডিসিয়াল একাডেমি’র আদলে ‘বাংলাদেশ জুডিসিয়াল একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করা, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের পর বিচারকদের দায়িত্ব দেওয়া এবং মিথ্যা, হয়রানিমূলক মামলায় ক্ষতিগ্রস্তকে ক্ষতিপূরণ দিতে আইন প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

‘মো. জালাল উদ্দিন মিয়া ও অন্যান্য বনাম আবদুল আওয়াল ও অন্যান্য মামলা’র রায়ে এমন পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এক সিভিল রিভিশনের ওপর জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চের দেওয়া ওই রায় সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

রায়ে অধস্তন সব আদালতের সেরেস্তাদারকে সিভিল রুল অ্যান্ড অর্ডারের বিধি ৫৫ অক্ষরে অক্ষরে পালনের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এবং সেরেস্তাদাররা তা সঠিকভাবে পালন করছেন কিনা সেটি সংশ্লিষ্ট সব সেরেস্তাদারদের নিয়ন্ত্রণকারী বিচারকদের দেখভাল করতে বলা হয়েছে।

পাশাপাশি দেওয়ানি মামলা পরিচালনার জন্য ব্যবহারিক নির্দেশাবলীর ম্যানুয়াল (Manual of Practical Instructions for the Conduct of the Civil Cases) অনুযায়ী সব দেওয়ানি আদালতের বিচারকদের বিচার কাজ পরিচালনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

এই রায় ও আদেশের অনুলিপি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে পাঠনোর জন্য রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অবগতি ও পর্যালোচনার জন্য রায় ও আদেশের অনুলিপি অধস্তন আদালতের সব বিচারককে ইমেইলের মাধ্যমে পাঠনোর জন্য রেজিস্ট্রার জেনারেলের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

একইসঙ্গে রায় ও আদেশের অনুলিপি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ দেশের সব আইনজীবী সমিতিতে ইমেইলের মাধ্যমে পাঠাতে বলা হয়। এছাড়া রায় ও আদেশের অনুলিপি বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পাঠাতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি রায়ের অনুলিপিসহ নথি সংশ্লিষ্ট আদালতে দ্রুত পাঠানোর নির্দেশও রয়েছে।

হাইকোর্ট এই রায়ে ১৫ দফা পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলো হলো—
১। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, বিজ্ঞ আইনজীবী, সরকারি আইন কর্মকর্তা এবং বিচার বিভাগের সহায়ক কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের জন্য ‘ন্যাশনাল জুডিসিয়াল একাডেমি, ভারত’ এর আদলে সুবিধাজনক নিরিবিলি পরিবেশে এক হাজার হেক্টর জায়গার উপর ‘বাংলাদেশ জুডিসিয়াল একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করা।

২। বিচারকদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স ছয় মাসে উন্নীত করা এবং এই প্রশিক্ষণকালে তাদের মনোজাগতিক বিকাশের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

৩। বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনে প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের সময় আবশ্যিকভাবে একজন মনোবিজ্ঞানিকে ভাইভা বোর্ডে সদস্য রাখা।

৪। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স সমাপ্ত হওয়ার পরই নবনিযুক্ত বিচারকদের বিচারিক দায়িত্ব দেওয়া।

৫। সব পর্যায়ের বিচারককে প্রতি বছর অন্তত দু’বার পনের (১৫) দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

৬। বিচারকদের দেশের বাইরে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। সেক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় জুডিসিয়াল ট্রেনিং সেন্টার/ ইন্সটিটিউট/ একাডেমির সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমঝোতা স্মারক (MOU) স্বাক্ষর করা।

৭। দেওয়ানি কার্যবিধি, Civil Rules and Orders এবং Manual of Practical Instructions for the Conduct of the Civil
Cases এর ব্যাপক সংশোধন যুগোপযোগী এবং উন্নত করা।

৮। যুক্তরাজ্যের আদলে মিথ্যা, হয়রানিমূলক, অযৌক্তিক ও হেতুবিহীন দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ/খরচ দেওয়া সংক্রান্ত আইন ও বিধি প্রণয়ন করা।

৯। দেওয়ানি বিচার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত সেরেস্তাদার পদটিকে নন-গেজেটেড প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা। এই পদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিচার বিভাগীয় সহায়ক কর্মচারীদের পদ-পদবির পরিবর্তন করা।

১০। এফিডেভিটের মাধ্যমে সিভিল মামলায় (ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল এর মতো) জবানবন্দি গ্রহনের বিধান করা।

১১। দেওয়ানি মামলার আপোষ নিষ্পত্তি এবং জারি মামলার ক্ষেত্রে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারকে আরও সম্পৃক্ত করা এবং তার এখতিয়ার, ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। তৎমতে আইন ও বিধি সংশোধন করা।

১২। প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ এবং বিচারকের নিরাপত্তার ব্যবস্থাসহ পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট বৃদ্ধি করা।

১৩। Online Filing এবং Online Cause list এর মাধ্যমে মামলা ব্যবস্থাপনা করা।

১৪। একজন আইনজীবী তথা অ্যাডভোকেট আদালতের অফিসার। দেশ ও সমাজের প্রতি অ্যাডভোকেটগণের কর্তব্য এবং দায়বদ্ধতা অপরিসীম। কোন অবস্থাতেই মিথ্যা, আইনগত অধিকারবিহীন, অযৌক্তিক ও অন্যকে হয়রানিমূলক মোকদ্দমা দায়েরে সহযোগিতা না করা। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আইনজীবীদের দেশ ও সমাজের প্রতি উপরোল্লিখিত কর্তব্য সম্পর্কে গুরুত্ব দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতামূলক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এর আয়োজন করলে মামলা জট অনেকাংশে কমে যেতে বাধ্য। আশা করি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।

১৫। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ বাংলাদেশের সব আইনজীবী সমিতিসমূহ এ ব্যাপারে সভা ও সেমিনার আয়োজন করে বেআইনি ও আইনগত অধিকারবিহীন অহেতুক মিথ্যা হয়রানিমূলক মোকদ্দমা পরিহার করতে স্ব-স্ব সমিতির আইনজীবীদের সচেতন করলে দেশ ও সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যেমনটি পালিত হবে তেমনি প্রয়োজনীয় বিরোধ নিষ্পত্তিতে বিচারিক সময় ব্যয় করা যাবে এবং মামলাজট হ্রাস পাবে।

পরামর্শসমূহ দ্রুত কার্যকর করলে ভয়াবহ মামলাজট থেকে অনেকটাই বের হয়ে আসতে পারবো। আইন মন্ত্রণালয় এই ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনগণের বিচার পাওয়ার পথ সুগম করবে বলেও আশা বিচারকদের।

মামলার বিবরণে জানা যায়, মামলার ১নং বিবাদী নির্বাহী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন হস্তান্তর সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে বাদী (আলহাজ আবদুল আওয়াল ও অন্যান্য) দেওয়ানি (মোকদ্দমা নং- ১৭৪/২০০৩) মামলা দায়ের করেন।

মামলার শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ২২ জুন কুষ্টিয়ার সিনিয়র সহকারী জজ, (সদর, কুষ্টিয়া) শেখ আবু তাহের কুষ্টিয়ার চালকলের মালিক এবং স্থানীয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গ্রাহক আবদুল আওয়াল ও অন্যদের আর্জি প্রত্যাখ্যান করেন এবং অস্থায়ী ও অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার দরখাস্তও সরাসরি নামঞ্জুর করেন।

এরপর এই রায় ও আদেশে সংক্ষুদ্ধ হয়ে বাদীপক্ষ (আবদুল আওয়াল ও অন্যান্য) কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন। পরে আপিল আবেদনের শুনানি শেষে ২০০৫ সালের ১৬ আগস্ট কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, ১ম আদালত এর বিচারক মো. ফজলুর রহমান সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল মঞ্জুর করেন।

পরবর্তীতে উপরিল্লিখিত রায় ও ডিক্রিতে সংক্ষুদ্ধ হয়ে বিবাদীপক্ষ (নিম্ন আদালতের বিবাদী পক্ষরা) কুষ্টিয়ার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং অন্যদের মধ্যে মো. জালাল উদ্দিন মিয়া ও অন্যরা হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন দায়ের করেন।
ওই বিষয়ে ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। এরপর ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করেন আদালত।

হাইকোর্টে আপিল আবেদনকারী জালাল উদ্দিনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। আর বিবাদীপক্ষে (নিম্ন আদালতে বাদী) কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ‘এটি স্বীকৃত যে আমাদের বিচার বিভাগ ভয়াবহ মামলাজটে ন্যুজ্ব প্রায়। প্রতিদিনই এ মামলাজট ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর থেকে উত্তোরণের উপায় খুঁজতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ কার্যত দিশেহারা। একজন সৎ, দক্ষ, কর্মঠ, দেশপ্রেমিক এবং সক্রিয় বিচারক আইনগত অধিকারবিহীন অযৌক্তিক, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মোকদ্দমা শুরুতেই ছুড়ে ফেলে দিতে সক্ষম। এই মোকদ্দমাটি শুরুতেই ছুড়ে ফেলে দিয়ে কুষ্টিয়া সিনিয়র সহকারী জজ, (কুষ্টিয়া সদর) শেখ আবু তাহের দেওয়ানী কার্যবিধির Order 7 Rule 11 (a) এবং (d) অনুযায়ী আইনগত দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে প্রতিপালন করেছেন, তেমনি মামলাজট কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।’

অপরদিকে কুষ্টিয়া অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, ১ম আদালতের, (আপিল আদালত) বিজ্ঞ বিচারক মো. ফজলুর রহমান আইনের ভুল ব্যাখ্যা করে আপিল মঞ্জুর করেছেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেছেন, ‘একজন দক্ষ বিচারক তৈরি করতে হলে প্রথমেই তাকে দীর্ঘমেয়াদী বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করতে হবে এবং উপরোক্তভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরির পরেই একজন বিচারককে বিচার কাজ পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে। তবেই অযৌক্তিক, বেআইনি ও হয়রানিমূলক মোকদ্দমা থেকে বিচার বিভাগ যেমন মুক্ত হবে, তেমনি মামলা জটও কমে যাবে।’

সারাবাংলা/কেআইএফ/এমও

জুডিসিয়াল একাডেমি হাইকোর্ট

বিজ্ঞাপন

সিইসি ও ৪ কমিশনারের শপথ আজ
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০১:৩৩

ফের দাপট দেখালেন সাকিব
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০৪

আরো

সম্পর্কিত খবর