বঙ্গবন্ধু-১ এর আকাশযাত্রার যন্ত্রগাঁথা
১২ মে ২০১৮ ০৬:২৫
।সন্দীপন বসু।
বাংলাদেশের নিজস্ব কৃত্তিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু-১’ মহাকাশে যাত্রা করেছে এবং পৌঁছেছে ভালোভাবেই। এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হলো। একইসঙ্গে ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর কেনেডি স্পেস সেন্টারের কেপ কেনভেরাল লঞ্চ প্যাড-৩৯ থেকে ফ্যালকন নামে রকেটের নবম সংস্করণের প্রথম সফল উৎক্ষেপণ হলো এটি।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ অনুসন্ধান ও মহাকাশ যান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্স ফ্যালকন-৯ রকেটে করে মহাকাশযানটিকে উৎক্ষেপণের পর নিজেদের ওয়েবসাইটে পুরো উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়াটির বিস্তারিত জানিয়েছে। স্পেসএক্সের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী উৎক্ষেপনের ৩ মিনিটের মধ্যে স্যাটেলাইটটি মহাকাশে পৌঁছে। এরপরই খুলে যায় ফ্যালকন রকেটের একাংশ। কাজ শুরু করে আরেক অংশটি। এর ৯ মিনিটের মধ্যে আটলান্টিকে ভাসমান ড্রোন স্থাপনায় ফিরে আসে ফ্যালকনের প্রথম অংশটি। আর এর ৩৩ মিনিট পর উৎক্ষেপণযান বা রকেট ফ্যালকন-৯ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটিকে মহাকাশে ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত ভূ-স্থির পরিবহন কক্ষপথ (অরবিট প্লটে) পৌঁছে দিয়ে আসে। সেখানে তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনের নিয়ন্ত্রণে আছে ‘বঙ্গবন্ধু-১’।
স্পেসেএক্স নিজেদের ওয়েবসাইটে পুরো প্রক্রিয়াটির বর্ণনা দিয়েছে। ওয়েবসাইটে বলা হয় উৎক্ষেপণের আগে প্রথমে ফ্যালকনের প্রোপিল্যান্ট লোডিং যাচাই করা হয়। এর পরের ধাপে আরপি-১ (রকেট জ্বালানি) লোড করা হয়। প্রথম পর্যায়ের এলওএক্স (তরল অক্সিজেন) লোডিং, দ্বিতীয় পর্যায়ের এলওএক্স লোডিং করার পরে উৎক্ষেপনের আগে ফ্যালকন-৯ এর ইঞ্জিন শীতলীকরণ করা হয়। এর পরের ধাপ চূড়ান্ত উৎক্ষেপণের আগে ডক কম্পিউটার পরীক্ষা ও প্রপিল্যান্ট ট্যাংক প্রেশারাইজেশন সম্পন্ন করা হয়। এরপর স্পেসএক্সের লঞ্চ ডিরেক্টর উৎক্ষেপণের চূড়ান্ত ভেরিফিকেশন জানান। আর এরপরই স্যাটেলাইটের রকেট ছাড়ার অনুমতি মেলে। ইঞ্জিন ইগনিশন প্রক্রিয়া চালুর নির্দেশ দেয় ইঞ্জিন কন্ট্রোলার বিভাগ এরপর ফ্যালকন-৯ উড়ে যায় মহাকাশের উদ্দেশে।
উৎক্ষেপণের পরের কর্মকাণ্ডও কিন্তু কম নয়। উৎক্ষেপণের ৩ মিনিট পরে রকেট সর্বোচ্চ মেকানিক্যাল স্ট্রেসে পৌঁছায় এরপরই প্রথম ধাপের মেইন ইঞ্জিন কাট-অফ করা হয়। এরপর দ্বিতীয় ধাপের ইঞ্জিন থেকে প্রথম ধাপ আলাদা করা হয়। এরপর দ্বিতীয় স্টেজের ইঞ্জিন (এসইসিও-১) চালু করে মহাকাশে প্রথম স্টেজের ল্যান্ডিং সম্পন্ন হয়। এরপর কিছু সময় নিয়ে দ্বিতীয় ধাপের ইঞ্জিন (এসইসিও-১) কাট-অফ ও একই ইঞ্জিন (এসইসিও-২) পুনরারম্ভ করা হয়। এরপর সবশেষে দ্বিতীয় ধাপের ইঞ্জিন (এসইসিও-২) কাট-অফ করে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে ছেড়ে আসা হয়।
শুক্রবার দিবাগত রাত ২ টা ১৪ মিনিটে ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চ প্যাড-৩৯ থেকে মহাকাশপানে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের এই স্বপ্ন। এর আগে রাতে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে প্রস্তুতি শুরু হওয়ার তথ্য জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৩টা ৪৭ মিনিটে বঙ্গবন্ধু-১ এর যাত্রা বাতিলের পর স্পেসএক্স জানিয়েছিল শেষ মুহূর্তে গ্রাউন্ড সিস্টেমে সমস্যা দেখা দেয়ায় উৎক্ষেপণ বাতিল করা হয়। ওড়ানের জন্য রাখা রিজার্ভ ডে আজ শুক্রবার একই সময়ে ‘বঙ্গবন্ধু-১’ আবারও উৎক্ষেপণের চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।
প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টা ১৪ মিনিটে স্পেসএক্সের ফ্যালকন-৯ রকেটে করে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মহাকাশে পাড়ি জমানোর কথা ছিল। পরে সেই সময় বাড়িয়ে ৩টা ৪৭ মিনিটে নির্ধারণ করা হয়। পরে সময় আরও ১৫ মিনিট বাড়িয়ে ৪টা ২ মিনিটে উৎক্ষেপণের কথা বলা হয়। সবশেষে ৪টা ৭ মিনিটে উৎক্ষেপণের স্থগিতের কথা জানায় স্পেসএক্স।
তবে স্পেসএক্স জানিয়েছে, সাধারণত স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানোর ক্ষেত্রে সব সময়ই একটি অতিরিক্ত দিন হাতে রাখা হয়। কারণ, প্রথম দিন কোনো সমস্যা হলে যাতে দ্বিতীয় দিনটি কাজে লাগানো যায়। আর এক্ষেত্রে জানানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধু-১ উড়ানোর রিজার্ভ ডে শুক্রবার। সে অনুযায়ীই উড়ল স্যাটেলাইটটি।
বিশেষ এই ক্ষণের স্বাক্ষী হতে গতকালের মতো ইউটিউবে, টেলিভিশনের পর্দায় চোখ ছিল বিশ্বজুড়ে বাঙালির। এ যেন স্যাটেলাইটের মহাকাশযাত্রা নয়, বাঙালির মহাকাশযাত্রা। অনেকে আবার নিজের এলাকায় টাঙানো বড় পর্দায় প্রত্যক্ষ্য করেন বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু-১’কৃত্তিম উপগ্রহের মহাকাশের পথে রওনা হওয়ার মূহুর্তটি।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে দুই হাজার ৯০২ কোটি টাকা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা এবং অবশিষ্ট এক হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা বিডার্স ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে ব্যয় সংকুলান হয়েছে।
ছবি: সংগৃহিত
সারাবাংলা/ এসবি
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ বঙ্গবন্ধু-১ এর আকাশযাত্রার যন্ত্রগাঁথা সন্দীপন বসু সন্দীপন বসু কলাম