Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জামিনে মুক্ত হলেই উপহার গাছের চারা

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৯ জুলাই ২০২৩ ০৯:১৭

ঢাকা: বিভিন্ন অপরাধে কারাগারে বন্দী থাকা আসামীরা জামিনে মুক্ত হয়েই পাচ্ছেন একটি গাছের চারা। একইসঙ্গে একটি শুভেচ্ছা বার্তা তুলে দেওয়া হচ্ছে তাদের হাতে। এমন ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিয়েছে কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ।

বৃক্ষের মতো শুরু হোক নতুন জীবন—এই বোধ ও ধারণা নিয়ে জামিনে মুক্ত ব্যক্তিরা যেন সমাজে নতুনভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন, তেমনটা আশা করছেন কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ কর্তৃপক্ষ।

পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝেও উপহার হিসেবে কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে গাছের চারা। শিশুরা যেন সেই গাছের যত্ন করে প্রকৃতিমুখী হয়ে নিজেদের ভবিষ্যত গড়ে তোলে এমন ভাবনা থেকে এই উদ্যোগ নিয়েছে কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের এমন উদ্যোগ প্রশংসনীয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই কারাগার বা জেল শব্দ ব্যবহার হয় না। কারণ কারাগার শব্দের যে ধারণা, তা আসলে কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্যবহার হওয়ার জায়গা নয়। এটা এক ধরণের সংশোধন কেন্দ্র। কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশের এই উদ্যোগকে বলা যেতে পারে এই প্রক্রিয়ার একটি অংশ।

এই ইতিবাচকতার প্রমাণ মেলে মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়া মোয়াজ্জেম, জব্বারদের বক্তব্যে।

কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়ার পরে গাছের চারা উপহার পেয়ে মোয়াজ্জেম উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, ‘এরকম তো কোনোদিন শুনিনি, জেল থাকি ব্যারাইলে মানুষ গাছ দেয়। খুব ভালো লাগিল বায়।’

একইদিন জামিনে মুক্ত হয়ে জব্বার বলেন, ‘গাছ লাগাব, সুন্দর জীবন যাপন করব। আর কোনোদিনই মাদকের সাথে যুক্ত হব না।’

কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেকেই নানা কারণে কারাগারে যায়। কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হলেও একধরণের হতাশায় ভুগে থাকেন তারা। সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেক সময় তাদের জন্য নিজেদের শুধরে নেওয়াটাও কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। এমন অবস্থায় তাদের অপরাধ প্রবণতা কমিয়ে মানসিকভাবে প্রকৃতিময় করে তুলতে আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘যারা কারাগার থেকে জামিনে বের হচ্ছে তারা যেন মাদকসহ অন্যান্য অপরাধ ছেড়ে ইতিবাচক ও উন্নয়নমুখী জীবনের জয়যাত্রায় এগিয়ে যেতে পারে সেজন্য আমরা সাহায্য করছি। বাস্তবতা হচ্ছে সবুজে ভরপুর জীবন, প্রকৃতিময় মানুষ কম অপরাধপ্রবন হয়। এক্ষেত্রে গাছ ও প্রকৃতি নিউরো-ব্যালেন্সড বিইং হিসেবে রূপান্তর হয়ে মানুষের মাঝে অপরাধ করার মাত্রা কমিয়ে দেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আজ (মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই) আমরা জামিনে মুক্ত হওয়া ১৮ জনকে বিভিন্ন বনজ বা ফলজ গাছের চারা উপহার দিয়েছি। প্রতিদিন কুড়িগ্রাম কারাগার থেকে জামিনে মুক্তদের দেওয়া হবে গাছের চারা। প্রাথমিক পর্যায়ে পুরো জুলাই মাস এই কার্যক্রম চলবে।’

কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘আজ জামিনে মুক্ত হওয়া ১৮ জনকে আমরা গাছের চারা যখন উপহার দেই তারা খুবই অবাক হচ্ছিলেন। এ সময় আমার সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ.কে.এম ওহিদুন্নবী, কারাগারে জেলার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা আবু ছায়েম।’

শিক্ষার্থীদের হাতেও তুলে দেওয়া হচ্ছে গাছের চারা

কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ কর্তৃপক্ষ অবশ্য শুধুমাত্র কারাগারেই নয়। একইসঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের হাতেও তুলে দিচ্ছে গাছের চারা। ‘সবুজ করি কুড়িগ্রাম’ মাসব্যাপী কার্যক্রমের প্রথম পর্যায়ে ১০ হাজারের বেশি গাছের চারা বিতরণ করছে কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ কর্তৃপক্ষ।

কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন গাছ মন ভালো রাখে, সচ্ছলও করে। বাংলাদেশের কোনো স্থান যেন পতিত না থাকে। কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশ সবুজ করি কুড়িগ্রাম শ্লোগানে প্রথম ধাপে ফলজ, বনজ ও ওষুধি চারাগাছ বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আমরা আরও চারাগাছ বিতরণ করব।’

তিনি বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের বলি, আজ তোমাদের যে গাছটি দিচ্ছি সেটা কোনো সাধারণ গাছ নয়। এই গাছটি হলো তোমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের এক প্রতীক। তোমার সঙ্গে সঙ্গে এই গাছটিও বড় হবে এবং আগামী ২০ বছর পর তোমার প্রয়োজনে গাছটি তোমার বন্ধু হবে, পুঁজিতে পরিণত হবে গাছটি। তাই তোমাদের প্রতি আমার বিশ্বাস, এই গাছটির সঙ্গে সঙ্গে তোমরাও দেশের ভবিষ্যত নিরাপদ রাখবে এবং একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠবে।’

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরিফ বলেন, ‘সবুজ করি কুড়িগ্রাম উদ্যোগটি জেলাকে একটি সবুজ শহরে রূপান্তরিত করবে বলে আশা করি।’

রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি মো. আব্দুল আলীম মাহমুদ বিপিএম বলেন, ‘জলবায়ু সহনীয় বাংলাদেশের জন্য গাছ লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। জেলা পুলিশের এই ইতিবাচক উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। একটি গাছ আজীবনের বন্ধু।’

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ যা বলছেন

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কলোনিয়াল ইতিহাসের কারণে দীর্ঘসময় ধরে আমাদের এখানে অনেকেই মনে করেন কারাগার মানেই শাস্তি পাওয়ার জায়গা। কিন্তু আসলে বিষয়টা তা নয়। এটা কিন্তু এক ধরণের কারেকশন সেন্টার যেখানে অপরাধীরা নানাভাবে নিজেদের শুধরে নেয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন কারাগার শব্দ ব্যবহার হয় না। এমনকি দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশেই এখন কারেকশন সেন্টার বলে।’

তিনি বলেন, ‘মানুষ কারাগারে যায় সংশোধন হওয়ার জন্য। কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশের উদ্যোগটি তেমনই একটি উদ্যোগ। অর্থাৎ, কারাগারে থাকা কয়েদীদের জামিনের পরেও নিজেদের ইতিবাচকভাবে শুধরে নেওয়ার একটা উদ্যোগ। এমন অসংখ্য উদ্যোগ থাকতে পারে। যেমন কারাগারে কাউকে হাতের কাজ শেখানোটাও তাকে সংশোধন করে নেওয়ারই একটা অংশ।’

তিনি আরও বলেন, ‘কারাগারে নৈতিক শিক্ষাও দেওয়া হয়ে থাকে। সেটাও একধরণের সংশোধন করার উপায়। কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে যে গাছের চারা দেওয়ার মাধ্যমে তাকে পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত করানো হচ্ছে- সেটা নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার উদ্যোগ। গাছটাকে যখন একজন ব্যক্তি ধারণ করবে তখন তার সমাজ, পরিবার, পরিবেশ ও পৃথিবীর প্রতি একটা মায়া, মমত্ববোধ কাজ করবে। এমন ছোট ছোট বিষয়গুলোর কারণে তার ভেতর থেকে অপরাধ প্রবণতা কমে যেতে পারে।’

ডা. হেলাল বলেন, ‘এটা কতটুকু কাজ করবে বা কতটুকু সফল হবে তা ভবিষ্যতে গবেষণা করে জানা যাবে। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে এর কোনো ক্ষতি নাই।’

সারাবাংলা/এসবি/আইই


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর