Sunday 27 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জাপার ভরাডুবিতে হতাশ নেতাকর্মীরা

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২১ জুলাই ২০২৩ ২২:৩০ | আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৩ ১১:২৯

ঢাকা: জাতীয় পার্টির (জাপা) জনসমর্থন ক্রমন্বয়ে কমছে। ভোটের মাঠে এবং সমর্থনের দিকে বেহাল অবস্থা দলটির। স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন ও উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা এককভাবে অংশ নিয়ে কোথাও তারা জিততে পারেননি। এসব নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভরাডুবি হয়েছে। হতাশ নেতাকর্মীদের মাঝে দলের নেতৃত্বের পরিবর্তনের দাবি উঠেছে। দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরের পদত্যাগও চেয়েছেন অনেকে নেতা।

দল পরিচালনায় সঠিক নেতৃত্বের অভাব, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, নেতাদের সঙ্গে কর্মীদের দূরত্ব, কেন্দ্রের সিদ্ধান্তহীনতাসহ নানা টানাপোড়েনের কারণে এমন ভরাডুবি হয়েছে বলে জাপার দলীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সর্বশেষ ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিকদার আনিসুর রহমান পেয়েছেন ১৩২৮ ভোট। জমানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে তার। এই আসনটি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের। এই আসনে ২০০৮ সালে এরশাদ নির্বাচিত হয়েছিলেন।

গুলশান-বনানী-ক্যান্টনমেন্ট এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে জাপার এমন পরাজয়ের কারণে দলীয়নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) বনানীস্থ দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে জিএম কাদেরের পদত্যাগের দাবি করেছেন বলে জানা গেছে। তাদের দাবি, মেজর (অব.) সিকদার আনিসুর রহমানকে জিএম কাদের এককভাবে মনোনয়ন দেন। জিএম কাদের দলটির ৫ জন কো-চেয়ারম্যানের পরামর্শও শোনেননি। এমনকি দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও তাদের ডাকা হয় না।

দলের অপর একটি সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর রংপুর সিটি কর্পোরেশন (রসিক) নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির নেতারা বলছিলেন, সারাদেশে তাদের ভোটব্যাংক অক্ষত আছে। কিন্তু পরের নির্বাচনগুলোতে আর এ অবস্থা দেখা যায়নি। সম্প্রতি পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জাপার ভোটের সংখ্যা ছিল হতাশাজনক।

জাপা সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাপা প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন পেয়েছেন মাত্র ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট। গত ১২ জুন বরিশালে দলটির মেয়র প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস পান ৬ হাজার ৬৬৫ ভোট। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শফিকুল ইসলাম মধু পান ১৮ হাজার ৭৪ ভোট।

গত ২১ জুন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম বাবুল পান ৫০ হাজার ৮৬২ ভোট। আর রাজশাহীতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপন পান ১০ হাজার ২৭২ ভোট।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছয়টি আসনের উপনির্বাচন হয়। এর মধ্যে বগুড়া-৬ আসনে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নুরুল ইসলাম ওমর পেয়েছেন মাত্র ৬ হাজার ৯৯৫ ভোট। বগুড়া-৪ আসনে জাতীয় পার্টির শাহীন মোস্তফা কামাল পান মাত্র ৬ হাজার ৪৪৬ ভোট।

একাদশ সংসদের সাড়ে চার বছরে ৩৩টি আসনের ২৪টিতে সংসদ সদস্যদের মৃত্যু হওয়ায় উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংরক্ষিত আসনসহ সাত আসনে বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে আবারও ভোট হয়। এর মধ্য ছয়টিতে সরাসরি ভোট হয়। একটিতে পদত্যাগ করে সংসদ সদস্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় সেখানে উপনির্বাচন হয়। আরেকটিতে সংসদ সদস্য আদালতের সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় সদস্যপদ বাতিল হয়। এ ছাড়া দুটিতে দুইবার করে উপনির্বাচন হয়। একটিতে বিএনপির সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরও শপথ না নেওয়া, অন্যটিতে দুজন সংসদ সদস্য মারা যাওয়ায় উপনির্বাচন হয়। এসব আসনেও জাপার প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়।

চট্টগ্রাম-১০ আসনের সংসদ সদস্য আফছারুল আমীন গত ২ জুন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এতে আসনটি শূন্য হয়। এই আসনে উপনির্বাচন আগামী ৩০ জুলাই। ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের মৃত্যুতে গত ১৫ মে থেকে আসনটি শূন্য হয়। গত সোমবার (১৭ জুলাই) উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আসনটিতে। নির্বাচনে জাপার প্রার্থীর জমানত বাজেয়াপ্ত হয়।

একাদশ জাতীয় সংসদে উপনির্বাচন শুরু হয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুতে। তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও শপথ গ্রহণ করতে পারেননি। ২০১৯ সালের ৪ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।

পরে উপনির্বাচন হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জয়ী হওয়া আসনেও। একাদশ সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৬ আসন থেকে মির্জা ফখরুল নির্বাচিত হলেও ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি শপথ না নেওয়ায় আসনটি শূন্য হয়। সেই উপনির্বাচনে জয়ী হন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর বিএনপির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলীয় সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে আবারও উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ওই আসনে। এতে ৪৩ বছর পর আসনটিতে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী এমপি নির্বাচিত হন।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম-৮ আসনেও দুবার উপনির্বাচন হয়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে আসন থেকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন মাঈনুদ্দিন খান বাদল। ওই নির্বাচনের মাত্র ১১ মাসের মাথায় ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর বাদলের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়। ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোছলেম উদ্দিন আহমদ নির্বাচিত হন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ মারা যাওয়ায় আবারও শূন্য হয় আসনটি।

২০১৯ সালের ১৪ জুলাই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে তার সংসদীয় আসন রংপুর-৩ শূন্য হয়। পরে উপনির্বাচনে তার ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদ (সাদ এরশাদ) বিজয়ী হন।

এ ছাড়া বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একজন নারী সংরক্ষিত আসনের এমপিসহ সাত সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেন। গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগের ঘোষণা দিলে ঠাকুরগাঁও-৩-এর জাহিদুর রহমান, বগুড়া-৪-এর মোশারফ হোসেন, বগুড়া-৬-এর গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২-এর আমিনুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩-এর হারুনুর রশীদ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২-এর আবদুস সাত্তার ভূঞার আসনগুলো শূন্য হয়। সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি রুমিন ফারহানাও পদত্যাগ করেন। পরে এ বছরের ফেব্রুয়ারি ১ তারিখে উপনির্বাচন হয়। অন্য কোনো এমপি উপনির্বাচনে অংশ না নিলেও বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে আবদুস সাত্তার ফের নির্বাচিত হন।

কুয়েতের আদালতে সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম পাপুলের সাজা হওয়ায় লক্ষ্মীপুর-২ আসনটি শূন্য হয়। কুয়েতের ফৌজদারি আদালত ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি পাপুলকে নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন। এতে ওই আসনেও উপনির্বাচন হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের পক্ষে অংশ নেওয়ায় শেখ ফজলে নূর তাপস পদত্যাগ করলে ঢাকা-১০ আসনে উপনির্বাচন হয়।

এ ছাড়া গাইবান্ধা-৫ আসনে সাতবারের নির্বাচিত এমপি ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী গত বছরের ২২ জুলাই, ফরিদপুর-২ আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ১১ সেপ্টেম্বর, ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য সাহারা খাতুন ২০২১ সালের ১০ জুলাই, সিরাজগঞ্জ-১-এর এমপি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম ২০২১ সালের ১৩ জুন মৃত্যুবরণ করলে আসনগুলোতে উপনির্বাচন হয়।

টাঙ্গাইল-৭ আসনে একাব্বর হোসেন, সিরাজগঞ্জ-৬-এ হাসিবুর রহমান স্বপন, কুমিল্লা-৭-এ সাবেক ডেপুটি স্পিকার আলী আশরাফ, সিলেট-৩-এ মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েছ, কুমিল্লা-৫ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল মতিন খসরু, ঢাকা-১৪-তে আসলামুল হক, ঢাকা-৫-এ হাবিবুর রহমান মোল্লা, নওগাঁ-৬-এ ইসরাফিল আলম।

পাবনা-৪-এ শামসুর রহমান শরীফ ডিলু, বগুড়া-১-এ আবদুল মান্নান, যশোর-৬-এ ইসমাত আরা সাদেক, বাগেরহাট-৪-এ ডা. মোজাম্মেল হোসেন, গাইবান্ধা-৩-এ ডা. ইউনুস আলী সরকারের মৃত্যুতে আসনগুলোতে উপনির্বাচন হয়।

সারাবাংলা/এএইচএইচ/আইই

জাতীয় পার্টি জাপা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর