ঢাকা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলতি বছরের গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ২০ জুলাই থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার ঠিক এক দিন আগে ছুটি বাতিল করে ক্লাস চালু রাখার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে শীতে ছুটি সমন্বয়ের পরিকল্পনা রেখে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তবে দেশের বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিবেচনায় গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিলের এই সিদ্ধান্ত সমালোচনার ঝড় তুলেছে অনলাইন-অফলাইনে। ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে শিশুদের ঘরে নিরাপদে রাখা সহজ হতো বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদসহ বেশির ভাগ অভিভাবক। তবে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে রেখে ডেঙ্গু নিয়ে সচেতন করা সম্ভব বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
২০ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন ছুটি থাকার কথা জানানো হয়েছিল শিক্ষাপঞ্জীতে। দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ও মৃত্যুর সংখ্যা যখন বাড়ছে তখন এই ছুটি অনেকটা আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করছিলেন অভিভাবকেরা। কিন্তু বুধবার (১৯ জুলাই) সন্ধ্যায় অনেকটা আকস্মিকভাবেই শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এই ছুটি বাতিলের ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, এবার শিক্ষাবর্ষ শেষ করার জন্য সময় কম। আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠদান ও মূল্যায়ন শেষ করতে হবে। এছাড়াও একই সময়ের মধ্যেই শেষ করতে হবে বিদ্যালয়গুলো সকল বার্ষিক পরীক্ষা।
তিনি আরও বলেন, সে ক্ষেত্রে গ্রীষ্মের ছুটি বাতিল করে শীতের ছুটি বাড়িয়ে দেব, যেটা ডিসেম্বরে হবে। তাই মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি থাকছে না। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে এ ছুটি আগামী শীতের ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। কাজেই এখন ক্লাস চলবে।
গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিলের বিষয়টি নিয়ে ভিকারুননেসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ অভিভাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ সুজন সারাবাংলাকে বলেন, আমরা আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে ডেঙ্গু আতঙ্কে ভুগছি। গত কয়েক দিন ধরে আমার বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাই না। এই সময়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল হওয়ায় আরও টেনশন বেড়ে গেল।
রাজধানীর উত্তরা ১০ নং সেক্টরের বাসিন্দা সুমনা বিশ্বাস জানান, যেভাবে ডেঙ্গু বেড়ে চলেছে তাতে বাচ্চাকে স্কুলে দিতেই ভয় পাচ্ছি। এই সংকেটের মধ্যে ছুটি থাকলে বাচ্চারা বাসায় থাকতে পারত। এখন আসলেই টেনশন বেড়ে গেল।
রাজধানীর শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজিস্ট সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৯ জন। শিশুরাও কিন্তু এখন আক্রান্ত হচ্ছে। বলাবাহুল্য যে ডেঙ্গু সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি স্কুল কলেজগামী বাচ্চাদের।
তিনি বলেন, এডিস মশা দিনের বেলাতেও কামড় দেয়, যেগুলো শ্রেণীকক্ষের বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে থাকে। অধিকাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আশপাশের পরিবেশ এডিস মশার জন্মানোর জন্য আদর্শ। সেখানে নিয়মিত কীটনাশক ছিটানো হয় না, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয় না, বাচ্চাদের ফুলহাতা শার্ট, ফুলপ্যান্ট, পায়ে মোজা পরার কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয় না।
তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত কীটতত্ত্ববিদদের যে তথ্য তাতে এডিস মশা কিন্তু তার ধরণ পাল্টাচ্ছে। পরিষ্কার পানির পাশাপাশি নর্দমার পানিতেও সে বংশবিস্তার করতে সক্ষম হচ্ছে। এমন অবস্থায় আমার পরিচিত কয়েকজনের বাচ্চা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ঈদের ছুটি শেষে স্কুলে যাওয়া শুরু করার কয়েকদিন পর। এমন একটা অবস্থায় শুধু ডেঙ্গুর হাত থেকে বাঁচার জন্যও স্কুল কয়েকদিনের জন্য ছুটি দেয়া যায়। সেই সময়টুকুর মধ্যে যতটা সম্ভব এডিস মশা নিধন কার্যক্রম চালানো যায়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে ডা. জাহিদুর বলেন, তারা এটা কী ঘোষণা দিলো? পূর্বনির্ধারিত গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হওয়ার পর সেটি বাতিল ঘোষণা করল। কারণ জাতীয় নির্বাচনের আগে (নভেম্বর) বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করতে হবে! নীতিনির্ধারক হয়ে আগে থেকে নির্বাচনের তারিখ সরকার আগে জানতো না? গ্রীষ্মের ছুটি ঈদের ছুটির সাথে সমন্বয় করা গেল না?
তিনি বলেন, হ্যাঁ, বাসায় থেকেও শিশুরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি কী তার বিষয়ে নিশ্চয়তা কে দেবে অভিভাবকদের? শিক্ষাপ্রতিষ্টানের পরিবেশ যদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে শিক্ষার্থীদের সেখানে নেওয়া হয় তবে সেটা একটা বিষয়। কিন্তু সেটার জন্য ছুটি বাতিল করে শিক্ষার্থীদের নেওয়া কী জরুরি? শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে-এটা সঠিক। তারা শিক্ষকদের কথা বিশ্বাস করে। সেটা পালন করার চেষ্টা করে। কিন্তু হঠাৎ করে নেওয়া সিদ্ধান্তে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়েও কিন্তু সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়।
তিনি আরও বলেন, স্কুল বন্ধ রাখার বিষয়টি যেহেতু আগে থেকেই ঘোষণা দেওয়া ছিল তাই স্বাভাবিকভাবেই সেখানে সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি এমনটা বলা যেতে পারে। এমন অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চারপাশ আগে পরিষ্কার করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু তেমন কিছু না করে হুট করে সিদ্ধান্ত দেওয়াটা স্বাভাবিকভাবে অভিভাবকদের মাঝে দুশ্চিন্তা বাড়াবে। এমন অবস্থায় আসলে বাচ্চাদের গ্রীষ্মকালীন ছুটি পুনরায় ঘোষণা করে স্কুলগুলোকে এডিস মশা মুক্ত করার কাজে নজর দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সামনে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস আছে। অতীতে আমরা দেখেছি এই দুই মাসে ডেঙ্গুর বিস্তার কতটা ভয়ঙ্করভাবে ঘটে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ড. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ডেঙ্গু এবার যেভাবে ইতোমধ্যেই ছড়িয়েছে তা আতঙ্কজনক। এর মাঝে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত বা ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্ত আসলে খুব একটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। কারণ সারাদেশেই ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। বাচ্চারা বাসায় থাকলেও ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, স্কুলে যাওয়ার পরে যদি শিক্ষার্থীদের মাঝে ডেঙ্গু ও এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন করা যেতে পারে তবে সেটা একটা কার্যকর পরিকল্পনা হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান সময়ে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বিত কমিটি ও সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করা জরুরি হয়ে পড়ছে। ঠিক তেমনভাবে যেমনটা আমাদের দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সময় করা হয়েছিল। নইলে পরিস্থিতি আসলে কোথায় গিয়ে থামবে তা বলা কষ্টকর। যেভাবে প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে তাতে পরিস্থিতি কিন্তু ভয়ঙ্করই হয়ে উঠছে দিনের পর দিন।
ড. মোশতাক বলেন, কমিউনিটিকে জানানো বা সম্পৃক্ত না করলে এই কাজ কেবল সিটি করপোরেশন কর্মীদের দ্বারা কোনোভাবে সম্ভব হবে না। সুতরাং এখানে গণআন্দোলন দরকার, সিটি করপোরেশনের বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি হাজার শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবককে সম্পৃক্ত করতে হবে।
এর আগে, ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা দেওয়ায় দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করার নির্দেশনা দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর।
গত ৬ জুলাই দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে মাউশি বলেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলার মাঠ এবং ভবনগুলোর মাঝে সাধারণত পানি জমে থাকে। এছাড়া স্কুলের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য থাকা ফুলের টবেও পানি জমে। এডিস মশার প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে এগুলো উপযুক্ত স্থান। এ কারণে এগুলোকে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
বর্ষাকালে মাঠে বা ভবনে পানি জমা স্বাভাবিক হলেও তা দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে।
একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদেরকে নিয়মিত ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায় জানাতে স্কুল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছে অধিদফতর।