Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যুক্তরাষ্ট্রে ‍খুন হওয়া রমিমের পরিবার খুঁজছেন ৩ জবাব

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২১ জুলাই ২০২৩ ১৫:৪৫

ইয়াজ উদ্দিন রমিম, ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম ব্যুরো: মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন ইয়াজ উদ্দিন রমিম। কিশোর রমিমকে উন্নত মানুষ হিসেবে গড়ার আশায় আমেরিকা প্রবাসী বড় বোনের কাছে দত্তক দেন মা নাসিমা বেগম। ১৫ বছর বয়সে রামিম পাড়ি জমায় যুক্তরাষ্ট্রে। কম্পিউটার সাইয়েন্সে পড়ালেখার পাশাপাশি একটি গ্যাস স্টেশনে কাজ করতেন। সেখানেই ঘাতকের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারাতে হয়েছে রমিমকে।

রমিমের মৃত্যু তার পরিবারের কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আঘাত করেছে। একটি বুলেট শুধু রমিমকেই কেড়ে নেয়নি, ছারখার করে দিয়েছে তার বিধবা মায়ের সব আশাভরসা, একমাত্র বড় ভাই রিয়াজ আহমেদ আসিফের সব স্বপ্ন। আমেরিকার মতো একটি দেশে এমন হত্যাকাণ্ড মানতে পারছেন না তারা। শেষবারের মতো সন্তানের মুখটি দেখার জন্য নাসিমার বুকভরা আর্তনাদ, আর ভাইয়ের স্মৃতি বুকে নিয়ে রিয়াজের হাহাকার থামছেই না!

বিজ্ঞাপন

একটি সভ্য দেশে কেন প্রকাশ্যে রমিমকে এত অমানবিকভাবে খুন হতে হলো, কেন চারদিনেও কোনো আসামি ধরা পড়ল না, চারদিনেও সন্তানের মুখটিও একবার কেন স্বজনরা দেখতে পেলেন না— এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন রমিমের স্বজনরা।

গত মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৩টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের সেন্টলুইস শহরে কর্মস্থল বিপি গ্যাস স্টেশনে ইয়াজ উদ্দিন রমিমকে (২২) গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সেন্টলুইস শহরের পার্কওয়ে সেন্ট্রাল হাইস্কুল থেকে স্নাতক শেষ করে কমিউনিটি কলেজে কম্পিউটার সাইয়েন্সে পড়ালেখা করছিলেন রমিম। পাশাপাশি বিপি গ্যাস স্টেশনে কাজ করতেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, গ্যাস স্টেশনের বাইরে ইয়াজ উদ্দিনের গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। ডাকাতির উদ্দেশ্যে এসময় তার গাড়ির কাঁচ ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে একদল বন্দুকধারী। ইয়াজ উদ্দিন বাধা দিলে এক বন্দুকধারী তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। পরে পুলিশ এসে ইয়াজ উদ্দিনকে হাসপাতলে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে জ্যাটাভিয়ন স্কট নামের ১৯ বছরের এক তরুণকে খুঁজছে পুলিশ।

বিজ্ঞাপন

স্বপ্নের দেশে গিয়ে স্বপ্নের অপমৃত্যু

রমিমের বাড়ি চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার করেরহাট গ্রামে। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শামসুদ্দিন মীরসরাই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি মারা যান। রমিমের মা নাসিমা বেগম অসুস্থ অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী। বড় ভাই রিয়াজ আহমেদ আসিফ কক্সবাজারে ব্র্যাকের মানবসম্পদ কর্মকর্তা। তাদের বাসা চট্টগ্রাম নগরীর চন্দনপুরা দারুল উলুম মাদরাসার সামনে ফেরদৌস টাওয়ারে।

রিয়াজ আহমেদ আসিফ সারাবাংলাকে জানান, তার ফুফুও আমেরিকায় থাকেন। ফুফু তাদের সবাইকে আমেরিকা নিয়ে যাবার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়। বাবা মারা যাবার পর হঠাৎ তাদের পরিবারে যেন অন্ধকার নেমে আসে।

দুই ছেলেকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন মা নাসিমা। বড় ছেলেকে নিজের কাছে রেখে ছোট ছেলেকে আমেরিকায় পাঠানোর জন্য স্বজনদের অনুরোধ করেন। নাসিমার বড় বোন তখন রমিমকে দত্তক সন্তান হিসেবে গ্রহণ করে আমেরিকায় নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।

রমিমকে আইনগতভাবে খালা’র কাছে দত্তক দেওয়া থেকে শুরু করে আমেরিকায় পাঠানোর সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বাংলাদেশে দফতরে-দফতরে ঘুরে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে বলে জানান রিয়াজ।

‘একেকটা সরকারি অফিসে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছি। সকালে গিয়ে সন্ধ্যায় বের হয়েছি। সবকিছু শেষ করতে আমার একমাস লেগেছিল, রীতিমতো যুদ্ধ করেছি। ২০১৬ সালের ৩০ জুলাই রমিম যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। আমার মা আর আমি ভেবেছিলাম, বাবা যেহেতু নেই, রমিমের বয়স কম, ছেলেপেলেদের সঙ্গে মিশে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তার চেয়ে আমেরিকায় বড় খালার কাছে থেকে জীবনটাকে একটু গুছিয়ে নিক, সেটা ভেবেই পাঠিয়েছিলাম।’

রিয়াজ বলেন, ‘রমিমকে যখন বিদায় দিচ্ছিলাম, আমি আর আমার মা একটুও কাঁদিনি। কারণ, আমাদের চোখে স্বপ্ন ছিল, সে সভ্য দেশে গিয়ে মানুষের মতো মানুষ হবে। রমিমও একটুও কাঁদেনি, তার চোখেও অনেক স্বপ্ন ছিল। আমেরিকায় পড়ালেখা শেষ করে ভালো ক্যারিয়ার গড়বে, আমার মা আর আমাকে আমেরিকায় নিয়ে যাবে, স্বপ্ন ছিল তার।’

‘বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, মীরসরাইয়ে আমরা একটা ভাড়া বাসায় থাকতাম। সেই বাসার নামই হয়ে গিয়েছিল- শামসুদ্দিন বাসা। অথচ আমার বাবা সেটার মালিক ছিলেন না। আমাদের দুই ভাইয়ের ইচ্ছা ছিল, সেই নামে মীরসরাইয়ে একটা বাড়ি করব। সৎভাবে পরিশ্রম করে দুই ভাই মিলে আমাদের ফ্যামিলিটাকে দাঁড় করাব ভেবেছিলাম, সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।’

শেষবার প্রিয় ছেলের মুখ দেখার অপেক্ষায় মা

শুক্রবার (২১ জুলাই) সকালে নগরীর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, শয্যাশায়ী নাসিমার দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। মাঝে মাঝে অস্ফুট কণ্ঠে শুধু ‘রমিম, রমিম’ বলে শব্দ করছিল। পাশে বসে স্বজনদের কেউ কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। ছেলের লাশ দেশে আসবে, এমন আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমিরকায় থাকা স্বজনদের ভিডিওকলেও যদি একবার ছেলের মুখটা দেখতে পেতেন, এ আশায় প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে তার। সাংবাদিক কথা বলতে চায় শুনে পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় কোনোভাবে উঠে বসলেন।

মা নাসিমা বেগম, ছবি: সারাবাংলা

মা নাসিমা বেগম, ছবি: সারাবাংলা

নাসিমা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘লাশ এখন পুলিশের কাছে। আমার বোনকেও একবার দেখতে দেয়নি। কেউ দেখতে পারেনি। শুনেছি, আজ জানাজা হবে। তারপর আবার লাশ পুলিশ নিয়ে যাবে। এখানে আনতে পারবে কি না জানি না। অনেক সময় লাগবে বলেছে। আমার বোন অনেক চেষ্টা করছে, এখনো তার মুখটা দেখতে পায়নি।’

কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, ‘আমি একবার ছেলের মুখটা দেখতে চাই, একবার আমাকে দেখতে দেওয়া হোক। বাংলাদেশ সরকার, আমেরিকার অ্যাম্বাসি যদি দয়া করে, তাহলে ছেলের মুখটা শেষবারের মতো দেখতে পাব।’

মৃত্যুর আগেরদিন ভিডিওকলে কথা হয়েছিল জানিয়ে নাসিমা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমাকে বলছিল, আম্মা আমি আপনার কাগজপত্র রেডি করতেছি। আপনাকে এখানে নিয়ে আসমু। চিকিৎসা করাব। আপনার জন্য এখানে বাড়ি কিনমু। আপনারে নিয়ে আমি এখানে থাকমু। গত সাত বছরে একবারও আসেনি। সাত বছর ধরে ছেলের মুখটা সামনে বসে দেখিনি, পাশে বসে আদর করতে পারিনি। এবছর দেশে আসার কথা ছিল, অথচ চলে গেল আল্লাহর কাছে। আমি কেমনে সহ্য করি!’

‘দিনে ৫-৬ ঘণ্টা ভিডিওকলে কথা বলত। ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করত। মাত্র চার ঘণ্টা ঘুমাত। পড়ালেখার যাতে ক্ষতি না হয়, সেজন্য সময় নষ্ট করত না। আমার ছেলেটাকে এত কষ্ট করে আমেরিকা পাঠালাম কি লাশ হওয়ার জন্য ?’

রিয়াজ জানালেন, তার সঙ্গেও মৃত্যুর আগের দিন রমিমের সঙ্গে ভিডিওকলে কথা হয়েছিল। আজ (শুক্রবার) মীরসরাইয়ে তাদের ফুপাতো ভাই সৌম্য’র বিয়ে। সৌম্যও সদ্য আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। এই বিয়ে নিয়ে অনেক উৎফুল্ল ছিল রমিম।

‘রমিম বলেছিল, সৌম্য ভাইয়ের বিয়েতে তো তোরা অনেক আনন্দ করবি! আমি বলেছিলাম, বিয়েতে তো কিছু দিতে হবে, তুই দশ হাজারটা টাকা পাঠায় দে। আজ বিয়েতে গিয়ে সেখান থেকে তাকে ভিডিওকল দেওয়ার কথা ছিল। রমিমও চলে গেল, বিয়ের আনন্দও মাটি হয়ে গেল।’

বড় ভাই রিয়াজ আহমেদ আসিফ, ছবি: সারাবাংলা

বড় ভাই রিয়াজ আহমেদ আসিফ, ছবি: সারাবাংলা

রিয়াজ বলেন, ‘বুকে বুলেট নিয়ে আমার ভাইটা অনেক কষ্টে মারা গেছে। তাকে (রমিম) কষ্ট দিয়ে আবারও দেশে আনা হোক, এমনটা আমরাও চাই না, আনতে পারলে ভালো হবে। আমরা শুধু একবার তার মুখটা দেখতে চাই।’

খুনের বিচার নিয়েও শঙ্কা

নাসিমা চান, তার ছেলে হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু বিচার আদৌ পাবেন কি না তা নিয়ে সন্দিহান তিনি ও পরিবারের সদস্যরা। কারণ তারা জানতে পেরেছেন, রমিমকে খুনের পর ধরা পড়া একজন হ্যান্ডকাপ পরা অবস্থায় পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে গেছে। এ তথ্য জানার পর তারা আরও মুষড়ে পড়েছেন।

নাসিমা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘যখন গুলি করল, তখন স্টেশনে দু’জন কাস্টমার ছিল। ওরা নাকি একজনকে ধরে পুলিশকে দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নাকি পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে গেছে। এটা কেমন কথা? ধরা পড়ল, আবার ছেড়ে দিল কেন? তিনি পালাতে পারলেন কিভাবে?’

রিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘পুলিশ কাস্টডি থেকে একজন খুনি পালিয়ে যাবে, তা-ও আমেরিকার মতো সভ্য দেশে, আমাদের বাংলাদেশেও তো সচরাচর এমন ঘটনা ঘটে না। এখন তো আমরা বিচার পাব কি না সেটা নিয়েও শঙ্কায় আছি।’

‘আমার ভাই যদি রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যেত, যদি অসুস্থ হয়ে মারা যেত, মনকে বোঝাতে পারতাম। কিন্তু আমেরিকার মতো একটা সভ্য দেশ, যে দেশ বিশ্বের অন্য সব দেশের নিরাপত্তা, মানবিকতা নিয়ে কথা বলে, সেখানে আমার ভাই এমন নিরাপত্তাহীন অবস্থায় মারা যাবে, এটা তো ভাবতেও পারছি না।’

নাসিমা বলেন, ‘আমার ছেলেকে যারা মেরেছে আমি ফাঁসি চাই। আমার ছেলেকে যেভাবে মেরেছে, তাদেরও সেভাবে মারতে হবে। তাদের ফাঁসি না হলে আমি শান্তি পাব না।’

সারাবাংলা/আরডি/এনএস

আমেরিকা ইয়াজ উদ্দিন রমিম যুক্তরাষ্ট্র

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর