আ.লীগে দ্বন্দ্ব বিএনপির প্রায় নিশ্চিত, প্রার্থী সংকটে জাপা
২২ জুলাই ২০২৩ ১৯:৫৪
ঢাকা: একসময় কুড়িগ্রাম ছিল জাতীয় পার্টির ঘাঁটি। এই জেলার সবক’টি আসনই তাদের দখলে থাকতো। কিন্তু এখন সেই চিত্র আর নেই। টানা মেয়াদে থাকা আওয়ামী লীগের দখলে চলে গেছে জেলার তিনটি আসন। সেজন্য মাঠে আওয়ামী লীগের অবস্থান আগের চেয়ে শক্ত। তবে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও রয়েছে প্রবল। আর আসনগুলোতে বিএনপির একাধিক শক্তিশালী প্রার্থী থাকায় তারাও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন। এদিকে, জাতীয় পার্টি তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে এবার মরণ কামড় দেবে— এমন আলোচনা রাজনৈতিক মহলে। আর কুড়িগ্রামে চরমোনাইর পীরের অনেক অনুসারী থাকায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভোটের মাঠে তারাও ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে।
নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে কুড়িগ্রামের চারটি আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। মাঠে-ঘাটে ভোটের উত্তাপ বইতে শুরু করেছে। চলছে সম্ভাব্য প্রার্থীর দোষ-গুণ নিয়ে আলোচনা। এদিকে, মনোনয়ন প্রত্যাশীরা পরিচিতি বাড়াতে নিজের ছবি সম্বলিত বিলবোর্ড, ফেস্টুন ও ডিজিটাল ব্যানার লাগিয়ে সরগরম করে তুলছে ভোটের মাঠ। সেইসঙ্গে মনোনয়নের জন্য দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও তদবিরও রক্ষা করে চলছেন তারা। ফলে দলে বাড়ছে গ্রুপিং-লবিং।
উলিপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ১২টি এবং চিলমারী উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত কুড়িগ্রাম-৩ (উলিপুর-চিলমারী) আসন। এটি জাতীয় সংসদের ২৭ নম্বর আসন। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনগুলোর মধ্যে এই আসনটিতে জাতীয় পার্টি জিতেছে ছয় বার। আওয়ামী লীগ জয় পায় তিন বার। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একমাত্র জয় পায় বিএনপি।
এই আসনটি দীর্ঘদিন জাতীয় পার্টির দখলে থাকলেও গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দখলে চলে যায়। এই আসনের বর্তমান এমপি আবদুল মতিন। যদিও তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ নেওয়াসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠে। এমনকি সংবাদ সম্মেলন করে দলীয় নেতাকর্মী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তোলেন। এ কারণে আওয়ামী লীগ এবার আসনটিতে অন্য কোনো ত্যাগী নেতাকে চায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে দলীয় মনোনয়ন পেতে জোড় লবিংয়ের পাশাপাশি প্রচারণা চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগে একাধিক নেতা।
এই আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চায় জাতীয় পার্টি। এর আগে ২০১৮ সালে জাতীয় পার্টির এমপি এ কে এম মাঈদুল ইসলামের মৃত্যুতে শূন্য আসনটিতে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয় দলীয় প্রার্থী ডা. আক্কাস আলী। কিন্তু তিনি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাপার মনোনয়ন পেলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। এর পর তিনি যোগ দেন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন বাংলাদেশ-এ। এবার তিনি ওই দল থেকে নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে। সেজন্য জাপা এই আসনে উপযুক্ত প্রার্থী সংকটে ভুগছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে উলিপুর জাতীয় পার্টিতে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। পাল্টাপাল্টি কমিটি ও অফিসের কারণে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়েছে। তবে জি এম কাদেরের অফিস সহকারী ডা. মেহেজুবুন নেছা টুম্পা সম্প্রতি উলিপুরে বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করছেন। কিন্তু এই আসনে জাতীয় পার্টি যদি মহাজোটের সঙ্গে না যায় তাহলে এককভাবে তাদের কোনো প্রার্থীর জয়লাভ করার সম্ভাবনা খুব কম।
আরও পড়ুন:
- জাপার পনিরের শক্ত অবস্থানে দখল নিতে চায় আ.লীগ প্রার্থী
- আসন পুনরুদ্ধারে জাপার ভরসা মোস্তাকেই, আ.লীগ-বিএনপিতে কোন্দল
এই আসনে বিএনপির অনেক নেতাই মনোনয়ন চায়। তবে জেলা বিএনপির সভাপতি শিল্পপতি তাসভীর উল ইসলাম মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে। তিনি যদি মনোনয়ন পান তাহলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি যেকোনো মূল্যে এই আসনের মনোনয়ন পেতে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া এখানে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রার্থী ডা. আক্কাস আলীও শক্ত প্রার্থী। তিনি এই আসনের নির্বাচনে ফ্যাক্টর হতে পারেন। ধারণা করা হচ্ছে, আসছে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রার্থীদের মাঝে চতুর্মুখী লড়াই হবে।
এদিকে, এই আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী হওয়ার ঘোষণায় সাধারণ ভোটাররা দ্বিধা বিভক্ত। স্থানীয় সাধারণ ভোটাররা মনে করেন এই আসনে এমনিতেই আওয়ামী লীগের অবস্থান অনেক ভালো। শুধুমাত্র স্থানীয় নেতাদের সমন্বয়হীনতার কারণে সাজানো একটি আসনে নানা প্রভাব পড়েছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে হতাশ তৃণমুলের নেতা-কর্মীরা। তাদের মধ্যে বাড়ছে বিভক্তি। তবে স্থানীয় নেতারা বলছে অন্য কথা। তাদের দাবি, বড় দলে নানা মতভেদ থাকবেই। আর উলিপুরের মানুষ রাজনীতি সচেতন। নির্বাচন এগিয়ে এলে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে। তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার অনুরোধ তাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা, উলিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আহসান হাবীব রানা দীর্ঘদিন ধরে মাঠের রাজনীতি করেছেন। বিরোধীদলে থাকা অবস্থায় বহু নির্যাতন সহ্য করেছেন। এবার তিনি এই আসনে মনোনয়ন চাইবেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি এই আসনে মনোনয়ন চাইব। তবে নেত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আমাকে মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করব, না দিলে দলীয় প্রার্থীর জন্য মাঠে কাজ করব।’
আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে উলিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা মতি শিউলী’র কথা শোনা গেলেও এখন তার অবস্থান অতটা শক্ত নয়। তবে তিনি মনোনয়নের জন্য চেষ্টা করছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকার নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী। একমাত্র আমিই নির্বাচনমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছি। নিরন্তর মাঠে পড়ে থেকে মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হয়ে কাজ করছি। সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে সহযোগিতা করছি। তাই আশা করি মনোনয়ন পাব।’
এদিকে, তরুণ নেতা সাজ্জাদুর রহমান সাজুর বাবা এ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। পারিবারিক রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই নেতাও ছুটছেন মানুষের পাশে। জনসংযোগ করছেন গ্রামে-গঞ্জে। জনগণের কাছে ভালো মানুষ হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। তিনিও মনোনয়ন দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে রয়েছেন।
এ ছাড়া প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা উলিপুর বণিক সমিতির সভাপতি সৌমেন্দ্র প্রসাদ পান্ডে গবাও এবার মনোনয়ন চাইবেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সারা জীবন দলের জন্য শ্রম দিয়েছি। নেত্রীর কাছে কিছু চাইনি। মানুষের আরও সেবা করার জন্যই এবার মনোনয়ন চাইব।’
অপরদিকে, বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে জেলা সভাপতি তাসভীর উল ইসলামের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল খালেকের নামও শোনা যাচ্ছে। নির্বাচন উপলক্ষে ইতোমধ্যে তিনি এলাকায় যাতায়াত শুরু করেছেন। ছাত্রদলের সাবেক এই ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাজনীতি করতে গিয়ে নানা নির্যাতন সহ্য করেছেন। এমনকি দীর্ঘদিন জেলও খেটেছেন। এলাকার জনগণ চায় এসব ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন হওয়া উচিত।
ডা. আক্কাসের এলাকায় জনপ্রিয়তা থাকলেও তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রার্থী হিসেবে। বিত্তবান এ শিল্পপতি নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচনি এলাকায় বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। এমনকি নানান কর্মকাণ্ড নিয়ে ছুটছেন গ্রামে-গঞ্জে। তিনিও নির্বাচনে ফ্যাক্টর হতে পারেন বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
উল্লেখ্য, আসনটিতে মোট ভোটার রয়েছে ৩ লাখ ৩ হাজার ১৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১লাখ ৪৭ হাজার ৭শ ৪২ জন, নারী ভোটার ১লাখ ৫৫ হাজার ২শ ৭১ জন। ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে জয় পান জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী এ কে এম মাইদুল ইসলাম। লাঙ্গল প্রতীকে তিনি ভোট পান ১ লাখ ৮৭ হাজার ৫২৮। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী তাসভীর উল ইসলাম হরিণ প্রতীকে পান ২০ হাজার ৮৭১ ভোট। ১০ ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাইদুল ইসলাম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করলে ওই আসনে জাপার মনোনয়নে ৮২ হাজার ৫৯৮ ভোট পেয়ে জয়ী হন ডা. আক্কাস আলী। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মতিন নৌকা প্রতীক পান ৭৯ হাজার ৮৯৫ ভোট। আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে আসনটি হারায় জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এম এ মতিন ১ লাখ ৩১ হাজার ৯১০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জেলা বিএনপি’র সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম পান ৬৯ হাজার ২৮৫ ভোট।
সারাবাংলা/জেডআই/পিটিএম
আহসান হাবীব রানা এম এ মতিন ডা. আক্কাস আলী তাসভীর উল ইসলাম দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মতি শিউলী সাজ্জাদুর রহমান সাজু সৌমেন্দ্র প্রসাদ পান্ডে গবা