উপনির্বাচনেই দ্বাদশের মহড়া দিচ্ছেন মহিউদ্দিন বাচ্চু
২৪ জুলাই ২০২৩ ২২:৫৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী পাঁচজন। এর মধ্যে ‘হেভিওয়েট’ হিসেবে আলোচিত একজনই, মো. মহিউদ্দিন বাচ্চু। আওয়ামী লীগের মনোনীত এই প্রার্থীর বিপরীতে চার জনের মধ্যে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছাড়া বাকিদের পরিচিতি তেমন নেই বললেই চলে। কেউ কেউ নানা ‘সমীকরণে’ এসে পড়েছেন ভোটের মাঠে।
জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কিছুটা পরিচিতি থাকলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে লড়াই করার মতো সাংগঠনিক শক্তি দৃশ্যমান নয়। ফলে দৃশ্যত খালি মাঠে একাই ‘খেলছেন’ মহিউদ্দিন বাচ্চু। শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকার পরও তুমুল প্রচার-প্রচারণা নিয়ে খালি মাঠে একাই লড়ে যাচ্ছেন তিনি, অনেকটা নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ের মতো।
মহিউদ্দিন বাচ্চু নিজেও মনে করেন, তার বিজয় সময়ের অপেক্ষামাত্র। এরপরও প্রচার-প্রচারণায় ‘শক্তিক্ষয়’ নিয়ে তার জবাব, ‘এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে, এই দিনেরে নেব আমরা সেই দিনেরই কাছে।’
জবাব কৌতুকপূর্ণ হলেও চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সাবেক আহবায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু’র মনোভাব আঁচ করা মোটেই কঠিন নয়। উপনির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীর মেয়াদ হবে মাত্র পাঁচ মাসের মতো। এরপর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনের জন্য নিজের শক্তির জানান দিতেই উপনির্বাচনের প্রচার-প্রচারণায় তার এত হাঁক-ডাক।
নৌকা প্রতীকের মহিউদ্দিন বাচ্চু’র সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা চার প্রার্থী হলেন- লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির সামসুল আলম, সোনালী আঁশ প্রতীকে তৃণমূল বিএনপির দীপক কুমার পালিত, ছড়ি প্রতীকে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের রশিদ মিয়া এবং রকেট প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী মনজুরুল ইসলাম ভূঁইয়া।
নগরীর হালিশহর, ডবলমুরিং, খুলশী, পাহাড়তলী, আকবর শাহ ও পাঁচলাইশের একাংশ নিয়ে চট্টগ্রাম-১০ সংসদীয় আসন। মোট ওয়ার্ড আটটি- শুলকবহর, দক্ষিণ কাট্টলী, সরাইপাড়া, পাহাড়তলী, লালখান বাজার, উত্তর আগ্রাবাদ, রামপুর এবং উত্তর হালিশহর। মোট ভোটার ৪ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৬। ছয় দিন পর ৩০ জুলাই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) এ আসনে ভোট হবে।
ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে এসে প্রায় দুই দশক ধরে যুবলীগের নেতৃত্ব দেওয়া মহিউদ্দিন বাচ্চুর সাংগঠনিক প্রভাব আছে চট্টগ্রাম নগরীতে, আছে অনুসারী নেতাকর্মী। রাজনৈতিক জীবনে বাচ্চুর প্রথম নির্বাচন এটি। সেজন্য অনুসারীদের মধ্যে উৎসাহ-উত্তাপের কমতি নেই। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দৃশ্যত গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
গত ১৩ জুলাই থেকে উপনির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হয়। শুরুর দিন থেকেই আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, যুব মহিলা লীগসহ থানা, ওয়ার্ড, ইউনিটভিত্তিক নেতাকর্মীরা প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। পাশাপাশি আইনজীবী সমিতি, কর আইনজীবী সমিতি, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, ১৪ দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও বৈঠক করে তাদেরও মাঠে নামাতে সক্ষম হয়েছেন নৌকার প্রার্থী।
চলছে ট্রাকে-ট্রাকে শোডাউন, মাইকিং, লিফলেট বিতরণ। নৌকার ব্যানার-পোস্টারে ছেয়ে গেছে পুরো নির্বাচনি এলাকা। প্রতিদিন নগর আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে ট্রাকে করে ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে ঘুরছেন মহিউদ্দিন বাচ্চু। পাশাপাশি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, মতবিনিময়, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান এবং ঘরোয়া বৈঠকেও যোগ দিচ্ছেন।
গত ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী, চান্দগাঁও) আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই উপনির্বাচনে এমন জোরালো প্রচারণা দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সেই প্রেক্ষাপটে মহিউদ্দিন বাচ্চু সাংগঠনিকভাবে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করছেন তারা।
জানতে চাইলে নৌকার প্রার্থীর প্রচার সেলের সমন্বয়ক ও নগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় সব ওয়ার্ডে আমরা প্রার্থীকে নিয়ে প্রচারণা চালিয়েছি। প্রত্যেক ওয়ার্ডে অন্তত দু’বার গেছি। পাড়া-মহল্লায় আমাদের নেতাকর্মীরা ডোর টু ডোর যাচ্ছেন। যেসব ওয়ার্ডে আমাদের মনে হচ্ছে প্রচারণা একটু কম হয়েছে, সেটার তালিকা করা হয়েছে। সেখানে আবার যাব।’
নির্বাচনি এলাকায় ঘুরে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের আশপাশে লাঙ্গলের প্রার্থী সামসুল আলমের কিছু পোস্টার-ব্যানার চোখে পড়েছে। তিনি নেতাকর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি চট্টগ্রাম-১০ আসনের ভোটার। এর বাইরে বাকি তিন প্রার্থীর প্রচারণা তেমন দেখেননি এলাকার লোকজন।
নগরীর লালখান বাজার এলাকার বাসিন্দা এস এম আবু ইউসুফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘নৌকা ছাড়া তো কারও পোস্টার-ব্যানার দেখিনি। প্রার্থী আর কে কে আছেন সেটাও জানি না, নামও শুনি নাই। ভোট দিয়েও কী হবে, নৌকা তো মনে করেন জিতেই গেছে।’
জাতীয় পার্টির প্রার্থী সামসুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘নৌকা মার্কার প্রার্থী যাচ্ছেন ট্রাকে চড়ে আর আমি যাচ্ছি ঘরে ঘরে। একেবারে ডোর টু ডোর গিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছি। এমন কোনো বাসা নেই যেখানে আমার লিফলেট, স্টিকার পৌঁছেনি। এমন কোনো ভোটার নেই যার সঙ্গে আমি হ্যান্ডশেক করিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের চেয়েও ভোটকেন্দ্রে ভোটার আনাকেই আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। কারণ, ঢাকা-১৭ আসনে দেখেছি, মাত্র ২৪ হাজার ভোট পেয়ে একজন প্রার্থী এমপি হয়েছেন। কী লজ্জার কথা! একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরও তো লাখের ওপর ভোট পান। এজন্য আমি ঘরে ঘরে গিয়ে লোকজনকে বলছি, আপনারা ভোটকেন্দ্রে আসুন। নির্বাচন কমিশনকে বলেছি, ভোটের দু’দিন আগে সেনাবাহিনীকে টহলে নামিয়ে দেন। ভোটারদের যদি নিরাপত্তা দিতে পারেন, ৫০ শতাংশ ভোট কাস্ট হবে।’
তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী দীপক কুমার পালিত নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় থাকা জাতীয় স্বাধীনতা পার্টির যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র। দলটি নিবন্ধন না পাওয়ায় তিনি নিবন্ধিত তৃণমূল বিএনপি থেকে প্রার্থী হয়েছেন। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি পটিয়া আসন থেকে প্রার্থী ছিলেন। তার বাড়ি বান্দরবানে। থাকেন চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানা এলাকায়।
দীপক কুমার পালিত সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের বাইরের কেউ নিই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী একজন কর্মী। নানা কারণে নির্বাচনকে এগিয়ে নিতে আমি প্রার্থী হয়েছি। আমি চেষ্টা করছি, নির্বাচনি আমেজ সৃষ্টির জন্য। ডোর টু ডোর গিয়ে মানুষকে ভোটকেন্দ্রে আসার জন্য বোঝাচ্ছি। নির্বাচনে হারজিত বড় কথা নয়, ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসুক এবং ভোটটা সুষ্ঠু হোক, এজন্য আমি প্রার্থী হয়েছি।’
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের রশিদ মিয়া’র বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলায়। তিনি চট্টগ্রামের বাসিন্দাও নন। একা একা নির্বাচনী এলাকায় ঘুরে ঘুরে রশিদ মিয়া’র লিফলেট বিতরণের ভিডিও ঘুরছে ফেসবুকে। তার সঙ্গে কথা বলতে পারেনি সারাবাংলা।
স্বতন্ত্র প্রার্থী মনজুরুল ইসলাম ভূঁইয়া চট্টগ্রাম-১০ আসনের বাসিন্দা। তার দাবি, তিনি একজন চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট এবং দুইটি পেশাজীবী সংগঠনের নেতা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলর ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল হক ডিউক তার ফুপাতো ভাই।
মনজুরুলকে অনেকে নৌকার ‘ডামি প্রার্থী’ মনে করলেও তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ২১ দফা ঘোষণা করেছি। পড়লে আপনি বুঝবেন, আমি ডামি প্রার্থী কি না। আমি ডিউক ভাইয়ের নির্বাচনে কাজ করেছিলাম, সেজন্য অনেকে মনে করতে পারেন। তবে আমি কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমি মনে করি, ৩০ জুলাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নৌকা এবং আমার প্রতীক রকেটের সঙ্গে।’
‘শক্তিহীন’ প্রার্থীদের সঙ্গে জিততে জোর প্রচারণা নিয়ে জানতে চাইলে মহিউদ্দিন বাচ্চু সারাবাংলাকে বলেন, ‘একজন রাজনৈতিক কর্মীর কাজ হচ্ছে, তিনি যা করবেন সেটা আগামীর দিকে তাকিয়ে করা। বলতে পারেন, আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত হতে যাচ্ছি। তার মানে এই নয় যে, আমি কোনো প্রার্থীকে দুর্বল বা শক্তিহীন ভাবছি। আমি আমার সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার সংগঠন মজবুত হোক, চাঙ্গা হোক, এটা তো আমি অবশ্যই চাইব। জনগণের কাছ থেকে ভালো সাড়া ও সমর্থন পাচ্ছি, এই সমর্থনকে যাতে ভোটের দিন পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারি সাংগঠনিক শক্তির মাধ্যমে, সেই লক্ষ্যে প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত থাকবে।’
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম