বসতভিটা হারিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন যমুনা পাড়ের মানুষ
২৭ জুলাই ২০২৩ ১৩:২৬
সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে জেলার ৬টি উপজেলার নদীপাড়ের বাড়ি-ঘর, দোকানপাট, ফসলি জমি, হাট-বাজার ও বিভিন্ন স্থাপনা যমুনায় তলিয়ে গেছে। ফলে ভিটামাটি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটছে ভাঙন কবলিত হাজারও মানুষদের। ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন তারা।
প্রতি বছরের মতো এবারও চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরু হয় যমুনা নদীর ভাঙন। জেলার শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, চৌহালী কাজিপুর উপজেলায় চলছে নদী ভাঙন। মুহূর্তের মধ্যে যমুনা গর্ভে চলে যাচ্ছে বাড়ি-ঘর, দোকানপাট, ফসলি জমি, হাট-বাজার ও বিভিন্ন স্থাপনা। অনেকে ভিটামাটি হারিয়ে নদীর পাড়েই পলিথিন টাঙ্গিয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনহারে অর্ধহারে দিন কাটছে তাদের। আবার অনেকে চলে গেছেন অন্য জেলায়।
গত এক থেকে দেড় মাসে ভাঙনের কবলে পড়ে শাহজাদপুর উপজেলার জামালপুর, এনায়েতপুরের ব্রাহ্মগ্রাম আড়কান্দিসহ দক্ষিণাঞ্চলে শতাধিক বসতভিটা নদী গর্ভে চলে যাওয়ায় ভিটামাটি ছাড়া হয়েছে হাজারও মানুষ। এছাড়া চৌহালী ও বেলকুচিতে যমুনার উভয় তীরেই চলছে ভাঙন।
সরেজমিনে শাহজাদপুর উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, যমুনা নদীর তাণ্ডবে বসত ভিটামাটি হারিয়ে এখন নদীর পাড়েই পলিথিন টাঙিয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেক অসহায় পরিবার। কেউ আবার ঘর তোলার কোনো জায়গা না পেয়ে স্তুপ করে রাখা বালুর উপরে কোনো রকমে বসবাস করছেন। তীব্র রোদে উত্তপ্ত হয়ে যাওয়া বালুর উপরে তাদের জীবন চলছে। এর সঙ্গে দেখা দিয়েছে খাবারের কষ্ট। নদী ভাঙনের কারণে তেমন কোনো কাজ-কর্মও নেই এসব এলাকায়। তাদের অনেকে দিনমজুরের কাজ করছেন। নদীতে বিলীন হওয়া গাছ তোলার কাজ করছেন অনেকে। সেগুলো বিক্রি করে কোনো রকমে পরিবার নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছেন।
জানা যায়, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলাধীন ব্রাম্মণগ্রাম-হাটপাচিল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় যমুনা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ এবং বেতিল স্পার-১ ও এনায়েতপুর স্পার-২ শক্তিশালীকরণ কাজ (প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত প্রকল্প) নামের প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুনে অনুমোদন হয়। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৬৪৭ কোটি টাকা। যা ৩০ জুন ২০২৪ এ শেষ হবার কথা রয়েছে। প্রকল্পে ৬টি অঙ্গ আছে। তবে এর কাজ শুরু হয়েছে অনুমোদনের প্রায় এক বছর পরে ২০২২ সালের এপ্রিল-মে মাসে। এর একটি অঙ্গ হলো ব্রাক্ষ্মণগ্রাম থেকে হাটপাচিল সাড়ে ৬ কিলোমিটার নদী তীর সংরক্ষণ কাজ। এটার প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪৭০ কোটি টাকা। মাদার ৬টি প্রকল্পের একটা অঙ্গ এটি।
আরও জানা যায়, ৬৪৭ কোটি টাকার প্রকল্পের বিপরীতে সরকার এখন পর্যন্ত বরাদ্দ দিয়েছে মাত্র ১৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বরাদ্দ দিয়েছে মাত্র ৭৮ কোটি টাকা। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে এসে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আরও ৬০ কোটি টাকা। প্রকল্পটির এখনো দৃশ্যমান কোনো কাজ হয়নি। এখন পর্যন্ত ব্লক বানানো, জিও ব্যাগ ডাম্পিং ও প্লেসিংয়ের কাজ চলছে। দেশের ১৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে এই প্রকল্পে।
জালালপুর ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামের সালাম শেখ বলেন, ‘যমুনার ভাঙনে ৬ বার ঘর-বাড়ি হারিয়েছি। বাড়ি পরিবর্তন করে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছি। এবারও ঘরের কোনায় নদী চলে এসেছে। যেকোনো সময় বসত বাড়ি নদীতে চলে যাবে। বসত ঘর ভেঙে পানির দামে বিক্রি করেছি। নদীর ডানতীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজ শুষ্ক মৌসুমে করতে পারলে নদী ভাঙত না। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন সঠিক সময়ে কাজ না করায় ভাঙনের মুখে পড়তে হয়েছে আমাদের।’
জালালপুর ইউনিয়নের কুটিপাড়া গ্রামের ইসমাইল হোসেনের ছেলে অটো চলক স্বপন বলেন, ‘তিন বছর আগে যমুনায় বাড়ি-ঘর ভেঙে চলে গেছে। তারপরে যেখানে এসেছিলাম, সেটাও ভেঙে গেছে রোজার আগে। পরিবারের ১৩ জন সদস্য এখন কে যে কোথায় আছে এটাও বলার মতো না। তবুও এখনো যদি ভাঙন বন্ধ করা যেত তাহলেও বেঁচে যেত অনেকে পরিবার।’
এনায়েতপুরের ব্রাহ্মগ্রামের ফজল আলী বলেন, ‘এখানে আমার বাড়ি ছিল। ২৫ বছর সেই বাড়িতে বসবাস করেছি। সাড়ে ১৬ ডিসিমালের বাড়ি, দুই বিঘা জমি, চারটি ঘরসহ সংসারের সব এখন নদীর পেটে। কোথায় যাব কি করব, কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে গ্রামের একটি মাদরাসার জমিতে বসবাস করছি। প্রতিদিনই ভাঙন হচ্ছে। এলাকার মানুষেরা নিঃস্ব হচ্ছে। যাওয়ার জায়গা পাচ্ছে না।’
এ ব্যাপারে জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘ভাঙন কবলিত মানুষগুলোর সার্বিক বিষয়ে ইউএনও স্যারকে জানানো হয়েছে। এছাড়া যে ১০ বান্ডিল টিন ও কিছু অনুদান এসেছিল, সেগুলো ভুক্তভোগীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।’
শাহজাদপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া আফরিন বলেন, ‘আমাদের অনুদানই খুব কম। তারপরও ওই এলাকাসহ ৩টি ইউনিয়নে কিছু টিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ও বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও ওই এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখবো কেমন কি দরকার। সেই অনুযায়ী আবার ডিসি (জেলা প্রশাসক) স্যারের কাছে চাহিদা দেওয়া হবে।’
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘চলতি বর্ষা মৌসুমে সিরাজগঞ্জের কয়েকটি উপজেলায় যমুনা নদীতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন রোধে জরুরি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে জিও ব্যাগ ডাম্পিং অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া শাহজাদপুরে একটি প্রকল্প অব্যাহত রয়েছে, যা জুন ২০২৪-এ শেষ হবে। এ প্রকল্পে সাড়ে ছয় কিলোমিটার তীর সংরক্ষণ কাজ রয়েছে। যেটি এনায়েতপুর স্পার থেকে হাট পাঁচিল পর্যন্ত বিস্তৃত। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার পরে অত্র এলাকার ভাঙন পুরোদমে রোধ করা যাবে। আশা করছি সঠিক সময়ের মধ্যেই প্রকল্পটি শেষ করতে পারব।’
সারাবাংলা/আরএ/এনএস