চট্টগ্রাম ব্যুরো: বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে চট্টগ্রামে এক মতবিনিময় সভায় সুষ্ঠু ভোটের পক্ষে সবার মতামত এসেছে। তবে ভোটের পদ্ধতি নিয়ে যথারীতি পরস্পরের বিরুদ্ধে মতও এসেছে।
সভায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি নিয়ে অনড় অবস্থান তুলে ধরে বিএনপি। বিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ী ও কালো টাকা থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করা এবং ভোটের শতাংশের প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণের দাবি তোলা হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আলাপের মাধ্যমে ভোটের পদ্ধতি নিয়ে দ্বিমত দূর করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) নগরীর মোটেল সৈকতে ‘দ্বৈত উত্তরণ: নির্বাচন ও উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় আসন্ন উত্তরণ- জনপ্রত্যাশা ও অংশীজনদের দায়িত্ব’ শীর্ষক এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ইউএসএআইডি ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই) এ সভার আয়োজন করে।
স্বাগত বক্তব্যে বিইআই’র প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রয়োজন। মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন খুবই জরুরি। মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু শান্তির জন্য আলোচনায় বসতে হবে। দেশ এখন যে পরিস্থিতিতে, তাতে সংঘাত কেউ চায় না।’
‘গত ৫২ বছরে বাংলাদেশ অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। সেটা ধরে রাখতে চাইলে শান্তির প্রয়োজন। অশান্তি শুধু অগ্রগতি থামায় না, সমাজকে ভেঙে দেয়। আমরা যথেষ্ট আত্মত্যাগ করেছি। আর বিধ্বংসী কিছুর প্রয়োজন নেই। দেশের ৮টি স্থানে আমরা মতবিনিময় করেছি। আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্বের যে প্রস্তাব সেটা বিবেচনা করা যায় বলে আমরা মনে করি।’
সভায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কেউ ছিলেন না। চট্টগ্রাম মহানগর আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মফিজুল হক ভূঁইয়া আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, ‘গায়েবি মামলায় আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি। চট্টগ্রাম শহরে ১৬টি থানা। মামলা আছে এক হাজার ২৭টি। আরও মামলা আছে। এসব মামলা কারা দিয়েছে, প্রশাসন দিয়েছে। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতো নেতার বিরুদ্ধে ৯টি মামলা আছে। ডাক্তার শাহাদাত হোসেনের বিরুদ্ধে ৯৮টি মামলা আছে। এভাবে কী সুষ্ঠু নির্বাচন হবে!’
‘আপনারা ভোট করতে চান। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত ভোট। কিন্তু ভোট কিভাবে হবে? গায়েবি মামলা মাথায় নিয়ে ভোট হবে? রাতের আঁধারে ভোট হবে? এই প্রশাসনের অধীনে? যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোট গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে তা দিতে সমস্যা কী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আপত্তি কোথায়? যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার শব্দে আপত্তি থাকে, তাহলে অন্য নাম দেন। অন্যের মতের প্রতি তো সহিষ্ণুতা থাকতে হবে। একজন আরেকজনকে সহ্য করতে না পারলে গণতন্ত্র হবে না।‘
পেশাজীবীদের মধ্যে কয়েকজনও দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, সেখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয়নি। সমান সুযোগ ছিল না। গত কয়েকটি নির্বাচন কেমন হয়েছে, তা সবাই জানে। বিপরীতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে সেগুলো গ্রহণযোগ্য হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করা কঠিন। একে অন্যকে দমনের নীতি থেকে বের হতে হবে। লিমিটেড ডেমোক্রেসি ও উন্নয়ন, সবার জন্য এ উন্নয়ন হয় না। একটা অংশ সম্পদ লাভ করে। সবাইকে নিয়ে উন্নয়ন হতে হবে।’
ইউনাইটেড লইয়ার্স ফ্রন্ট চট্টগ্রামের প্রধান সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট জহুরুল আলম বলেন, ‘সরকার ক্ষমতায় থাকবে, প্রশাসন তাদের হাতে থাকবে, তারা রাতে হোক দিনে হোক ভোট করবে, আর অন্যদের কিছু সিট দেবে। আর বলবে, তোমরা ভোটে আস, সেটা হয় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া গ্রহণযোগ্য ভোট সম্ভব নয়।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়বাদী শিক্ষক ফোরামের সদস্য সচিব অধ্যাপক নসরুল কদির বলেন, ‘দুর্নীতি, রাজনৈতিক অধিকার হরণ ও বাকস্বাধীনতা হরণ করে উন্নয়ন হয় না। মানুষ এখন নির্বাচন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এখন ১০ শতাংশ ভোট পড়ছে, ক’দিন পর জিরোতে চলে আসবে। তারপর মাইনাস।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) পক্ষ থেকে ভোটের হার অনুযায়ী প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। চট্টগ্রাম জেলা সিপিবির সভাপতি অশোক সাহা বলেন, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়ছে। ব্যবসায়ী ও কোটিপতিদের হাতে রাজনীতি জিম্মি। রাজনীতি ও চাঁদাবাজি একযোগে চলছে। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে কোনো ধরনের সরকারই টেকসই হবে না।’
জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘প্রধান দলগুলো থেকে যারা মনোনয়ন পাচ্ছেন, কালো টাকায় ভর দিয়ে। লুটপাটকারীরা নির্বাচনের সামনে চলে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যে অর্জন তা এখন কোথায়? ভোটের শতাংশের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণ করতে হবে সংসদে। দেশ কারো একার নয়, সবার।’
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘প্রচলিত ব্যবস্থায় যার টাকা নেই, সেই নেতা কি মনোনয়ন পাবেন? যে মনোনয়ন বাণিজ্য হয় তা কি একজন সৎ নেতার পক্ষে অতিক্রম সম্ভব? যারা সুষ্ঠ ভোটের কথা বলছেন তারা নিজেরা কি করেছেন সেটা ভুলে যান। সুতরাং নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। সংখানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে যেতে হবে। সামরিক-বেসামরিক আমলা তোষণের মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্র অর্জন সম্ভব না। বড় দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা নেই। সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভাজন এখন সর্বোচ্চ। ব্যাপক জনগোষ্ঠী রাজনীতি বিযুক্ত। রাজনীতির প্রতি মানুষের বীতশ্রদ্ধ ভাব কাটাতে হবে।’
সভায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে ভিন্ন, ভিন্ন মত এসেছে। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সোলায়মান আলম শেঠ বলেন, ‘নির্বাচন কিভাবে করব, রাতের নির্বাচন হলে আমরা যাব না। ঢাকা-১৭ আসনে কত ভোট কাস্ট হয়েছে? এভাবে হলে কেউ যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব কাকে দেবেন? আগেও তো দিয়েছিলেন। যেভাবেই হোক, সুষ্ঠু ভোট হতে হবে।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নেতা জসিম উদ্দিন বাবুল বলেন, ‘দেশ কি শুধু দুই দলের? অন্য কারও কি মতামত নেই? দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে, মাফিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। ভোটের কাঠামো পরিবর্তন দরকার। নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোট হবে। তারাই সব প্রার্থীকে নিয়ে সকল আসনে সভা করবে। ভোটে প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সংসদে প্রতিনিধি যেতে হবে।’
পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের চট্টগ্রামের সভাপতি ডাক্তার এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বিদেশি কূটনৈতিদের আমরা সকলে মিলে তোয়াজ করছি, যেন জনগণের কোনো প্রয়োজন নেই। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিদেশি কূটনীতিক নয়, আমার দেশের নির্বাচন এদেশের জনগণের চাওয়া অনুযায়ীই হতে হবে।’
সভায় ১৪ দলের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক ও নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপির ভাইয়েরা কথা বলেছেন। কিন্তু ওনারা এখানে কথা বলছেন, অথচ সংসদে যেখানে বললে কাজ হতো, সেখান থেকে ওনারা বেরিয়ে এসেছেন। সংসদে ওনারা তত্ত্বাবধায়কের দাবির কথা বলতে পারতেন। নির্বাচিত হলে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনবেন, এটার ঘোষণা দিতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে ওনারা সংসদ থেকে বেরিয়ে চলে এসেছেন।’
‘নির্বাচন নিয়ে দেখি অনেক বিদেশিও সরব। এদের বিরুদ্ধে আমরা একাত্তরে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছি। আমরা দেশের মানুষ এক হলে কেউ কিছু করতে পারবে না।’
ভোটের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন ভালো হতে হবে, এটাতে সবাই একমত। কিন্তু পদ্ধতি নিয়ে দ্বিমত আছে। আসুন, সেটা নিজেরা আলাপ করে ঠিক করি। বিএনপির ভাইয়েরা মামলার কথা বলেছেন। জেল-জুলুম আমরাও ভোগ করেছি, আমাদের চেয়ে বেশি কেউ হামলা-মামলা, নির্যাতনের শিকার হয়নি। ঢিল মারলে পাটকেল তো খেতে হবে। তবে আসুন, শপথ করি কেউ কাউকে মারবো না। সকল দেশপ্রেমিক শক্তিকে একমত হতে হবে, আমরা এক মায়ের সন্তান।’
সুজন আরও বলেন, ‘অনেকে অনেক কথা বলতে পারবেন, কিন্তু দেশের উন্নয়ন যে হয়েছে এবং সেই উন্নয়নের সুফল মানুষ ভোগ করছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। দেশের সম্পদ অতীতেও পাচার হয়েছে। যারা সম্পদ পাচারকারী, তারা বিশ্বাসঘাতক। তাদের এদেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।’
বিইআই’র জ্যেষ্ঠ্য গবেষণা কর্মকর্তা সৈয়দা ফারহানা রেজা’র সঞ্চালনায় সভায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল ভৌমিক, নারীনেত্রী জেসমিন সুলতানা পারু, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রদীপ দাশ, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক জাহিদুল করিম কচি, সাংবাদিক জসিম চৌধুরী সবুজ, আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান, ব্রাইট বাংলাদেশ ফোরামের উৎপল বড়ুয়া, ১৪ দল নেতা নজরুল ইসলাম আশরাফী বক্তব্য দেন।