অদেখা চোখে বিজয়ের হাসি
২৮ জুলাই ২০২৩ ১৫:৪৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: মা-বাবার কোল আলো করে পৃথিবীতে জম্ম নিলেও চোখের আলো ছিল না হিমু আইচের। তাই তাকে নিয়েই খুব চিন্তিত ছিলেন তার বাবা-মা। কিন্তু দৃষ্টির সীমাবদ্ধতাকে জয় করে সাফল্যের সঙ্গে এসএসসি পাস করে উজ্জ্বল করেছেন বাবা-মায়ের মুখ। তাই যেন খুশির শেষ নেই তাদের।
চট্টগ্রামের এমন অদম্য তিন পরীক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে সারাবাংলা, যাদের সবাই সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে তাদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। এসএসসির ফলাফল প্রকাশের পর শুক্রবার (২৮ জুলাই) দুপুরে কথা হয় তাদের সঙ্গে।
নগরীর টেরীবাজার আফিম গলি এলাকার বাসায় হিমু আইচের সঙ্গে কথা বলার সময় সঙ্গে ছিলেন তার বাবা নারায়ণ আইচ ও মা কল্পনা আইচ।
নগরীর রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে হিমু আইচ ৩ দশমিক ৬৭ পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই গান ও পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ ছিল তার। তবে অন্যন্য সাধারণ মানুষের মতো চোখের দৃষ্টি না থাকায় সাধারণ স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়নি তার।
ভর্তি হন মুরাদপুরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত স্কুলে। সেখানে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষা পাওয়ার পর ভর্তি হন হামজারবাগের রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখান থেকেই মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজ বা চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে ভর্তি হতে চান হিমু।
ছয় বছর বয়স থেকেই গান শিখছেন হিমু। ওস্তাদ সুব্রত দাশের কাছে দশ বছর গান শিখে গত বছর ভর্তি হয়েছেন চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমীতে। সেখানেও সবার প্রিয় পাত্র তিনি।
এ পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেক পরিশ্রম ও সাধনার কথা তুলে হিমু আইচ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল থেকেই অনেক টেনশনে ছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে অপেক্ষা করছিলাম কখন রেজাল্ট দেবে। এখন রেজাল্ট পেয়ে অনেক ভালো লাগছে। আমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।’
‘ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট করেছি। যেহেতু চোখে দেখতে পাই না তাই পড়ালেখা করতে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু আমি দমে যায়নি। আজকে আমার এই সফলতার মূল কারিগর আমার বাবা-মা। আমার স্কুলের শিক্ষকরা। তারা পাশে না থাকলে হয়তবা আমি আজ এতদূর আসতে পারতাম না।’
ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্নের কথা জানালেন হিমু।
হিমুর বাবা নারায়ণ আইচ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওর জম্মের পর থেকেই ওকে নিয়ে আমরা অনেক টেনশনে ছিলাম। কিন্তু সে তার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে আজ এতদূর এসেছে। রেজাল্ট দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমিও অনেক চিন্তায় ছিলাম। এখন অনেক খুশি। এর পেছনে আমার স্ত্রীর অবদান অনেক বেশি। আমি সারাদিন অফিসে থাকি। সেই সবকিছু করেছে।’
কল্পনা আইচ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার মেয়েকে নিয়ে আমি অনেক গর্ব করি। সে চোখে দেখতে না পারলেও তার মেধা ও পরিশ্রমে সে অন্যদেরও ছাড়িয়ে গেছে। ছয় বছর বয়স থেকেই সে গান শেখে। অনেক পুরষ্কার জিতেছে। ভারতেও গান গেয়ে পুরষ্কার জিতে এনেছে। এখন সম্পূর্ন নিজের পরিশ্রমেই সে মাধ্যমিক পাস করেছে। সে আরও অনেক দূরে যাক এটাই এখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা।’
হিমুর বড় ভাই অনিক আইচ বলেন, ‘আমার বোন পড়ালেখায় আমার চেয়েও অনেক ভালো। যদি তার দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক মানুষের মতো হতো তাহলে সে আরও ভালো রেজাল্ট করতে পারত।’
গায়ক হতে চান তন্নয়
চোখে আলো নেই। তবে ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ ছিলো তন্নয় দত্তের। সাথেও পারিবারিকভাবে গানের প্রতিও আলাদাভাবে টান ছিলো তার। তাই তো বড় হয়ে হতে চান দেশ সেরা গায়ক।
মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ফলাফল ভালো না হওয়ায় বেশ আক্ষেপ তার। নগরীর হামজারবাগের রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৩ দশমিক ৮৩ পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। মুরাদপুরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত স্কুলে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষা পাওয়ার পর ভর্তি হন ওই বিদ্যালয়ে। এখান থেকেই মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজ বা চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে ভর্তি হতে চান তন্নয়।
ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে গায়ক হওয়ার স্বপ্নের কথা জানালেন তিনি।
তন্নয় দত্ত সারাবাংলাকে বলেন, ‘চোখে দেখতে না পেলেও আমি আমার পড়াশোনা অনেক কষ্টে চালিয়ে গেছি। অনেক পরিশ্রমের ফসল এই ফলাফল। তবে আমার পরীক্ষা যেরকম ভালো হয়েছে সেভাবে আশানুরূপ রেজাল্ট পাইনি। আমি বোর্ডে চ্যালেঞ্জ করব।’
‘আমার বাবা নেই। মা অনেক কষ্ট করে আমাদেরকে লালন-পালন করে বড় করেছেন। মায়ের কাছ থেকেই গানের হাতেখড়ি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোথাও গান না শিখলেও বন্ধুদের সাথে গান করতাম। এভাবেই রাগ ও স্বরলিপি আয়ত্ত করেছি। ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে একজন ভালো গায়ক হতে চাই।’
নিজের জ্ঞানের আলো অন্যদের দিতে চান সামির
চোখের আলো নান থাকলেও নিজের জ্ঞানের আলোতে নিজেকেই উজ্জ্বল করেছেন সৈয়দ মুহম্মদ সামির। আর সে জ্ঞানের আলো দিয়েই সমাজের মানুষদের শিক্ষা দিয়ে গড়তে চান একটি মানবিক সমাজ। যেখানে কেউ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে না।
তিনিও নগরীর হামজারবাগের রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৪ দশমিক ২৮ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। ছয় বছর বয়সেই নিজের অধ্যাবসায়ে হয়েছেন কোরআনের হাফেজ। জেলা পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। থাকেন রাউজানের কাগতিয়া গ্রামে। পড়তে চান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সৈয়দ মুহম্মদ সামির সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফলাফল পেয়ে অনেক খুশি হয়েছি। ছয় বছর বয়স থেকেই আমি কোরআনের হাফেজ। বাড়িতে থেকেই আমি হাফেজ হয়েছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছে আছে। এরপর শিক্ষক হতে চাই। কেউ যাতে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকেই সবসময় কাজ করে যাবো। আমাদের মত অনেকেই আছে যারা অবহেলিত। তাদের জন্য কিছু করতে চাই।’
সারাবাংলা/আইসি/একে