চুরির টাকায় কোরবানি, বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে ভুঁড়িভোজ!
২ আগস্ট ২০২৩ ১৪:৫৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের রাউজানে এক প্রবাসীর বাড়ি থেকে নগদ প্রায় আট লাখ টাকা ও প্রায় ৮০ ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ বিভিন্ন মালামাল চুরির ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি তদন্তে নেমে ১০ দিনের মধ্যেই সংস্থাটি জড়িত চারজনকে গ্রেফতারের পাশাপাশি কিছু মালামাল উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।
পিবিআই জানিয়েছে, প্রবাসীর ঘর থেকে চুরির টাকায় চোরচক্রের দলনেতা কোরবানির গরু কিনেন এবং বাবার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ভোজের আয়োজন করেন। একইভাবে চুরির টাকায় আরেকজন একটি মোটর সাইকেল কিনেন।
গ্রেফতার চারজন হলেন, হেলাল উদ্দিন (৪৩), মো. সালাউদ্দিন (৩৪), মো. সোহাগ (৩৮) এবং আবুল কাশেম বাচা (৩২)। হেলাল, সালাউদ্দিন ও আবুল কাশেমের বাড়ি নোয়াখালী। সোহাগের বাড়ি সন্দ্বীপ উপজেলায়। আবুল কাশেম বর্তমানে মীরসরাইয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। বাকি তিনজন চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি এলাকায় থাকেন।
গত ৮ জুন বিকেল ৫টা থেকে পরদিন সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে কোনো একসময় চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নে ইয়াছিন নগর গ্রামে প্রবাসী আব্দুল কাদেরের বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রাউজান থানায় দায়ের করা মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, তার বাড়ি থেকে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল সেট, ক্যামেরা, ল্যাপটপসহ প্রায় ৫৫ লাখ ৪৩ হাজার ৫০০ টাকার মালামাল চুরি হয়েছে।
আব্দুল কাদের সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি ৩২ বছর বিদেশে ছিলাম। দেশে ফিরে পাকা বাড়ি তৈরি করি। আমার বাড়ি খুবই সুরক্ষিত, সিসি ক্যামেরা লাগানো ছিল। ঘটনার দিন আমরা পরিবারের সবাই একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আগেরদিন বৃষ্টির মধ্যে গাছ ভেঙ্গে পড়ে সিসি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।’
‘এ সুযোগে আমার ঘরের লোহার গেইট ও মূল দরজা ভেঙ্গে চোর প্রবেশ করে। আমার নিজের টাকা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা, আমার ছেলে মসজিদের ক্যাশিয়ার, তার কাছে থাকা আরও প্রায় দেড় লাখ টাকা, ৭০ থেকে ৮০ ভরি স্বর্ণালংকার চুরি হয়।’
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার দেড় মাসেও কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় গত ১৯ জুলাই আদালতে তদন্ত সংস্থা পরিবর্তনের আবেদন জানান আব্দুল কাদের।
চট্টগ্রাম জেলা পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার (এসপি) নাজমুল হাসান সারাবাংলাকে জানান, ২০ জুলাই মামলা তদন্তের দায়িত্বভার নেয় পিবিআই। ১০ দিনের মধ্যে চুরির সঙ্গে জড়িতদের এবং তাদের অবস্থান শনাক্ত করা হয়। এরপর মঙ্গলবার (১ আগস্ট) গভীর রাত পর্যন্ত টানা দুইদিন নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি, হাটহাজারী ও মীরসরাইয়ে অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়।
তাদের তথ্য অনুযায়ী অভিযান চালিয়ে নগরীর পাহাড়তলী থানার কর্নেলহাট এলাকার শতাব্দি জুয়েলার্স থেকে ৫ ভরি এবং হাটহাজারীর মীরা জুয়েলার্স থেকে আরও ৪ ভরি স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করা হয়। এছাড়া গ্রেফতার হওয়া চারজনের হেফাজত থেকে চুরি করা ডিজিটাল ক্যামেরা, দুইটি মোটর সাইকেল, একটি সিএনজি অটোরিকশা ও একটি মোবাইল সেট উদ্ধার করে পিবিআই।
এসপি নাজমুল হাসান বলেন, ‘গ্রামের মধ্যে একটি বাড়িতে চুরির ঘটনা, এটা একেবারেই ক্লুলেস ছিল। রাউজানে যে প্রক্রিয়ায় চুরির ঘটনা ঘটেছে, দেখা গেছে একইভাবে গত কয়েক মাসে হাটহাজারী-ফটিকছড়িতেও চুরির ঘটনা ঘটেছে। তখন আমরা তদন্তে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে একটি আন্তঃজেলা চোরচক্রকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এই চক্রের সদস্যরা দিনে বাড়ি রেকি করে। গভীর রাতে অটোরিকশায় গিয়ে চুরি করে।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা পিবিআইয়ের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. কামাল আব্বাস সারাবাংলাকে জানান, রাউজানে প্রবাসীর বাড়িতে চুরির ঘটনায় নেতৃত্ব দেয় আবুল কাশেম। তার সঙ্গে ছিল হেলাল ও বেলাল নামে দুই ভাই। দু’টি অটোরিকশা নিয়ে তারা চুরি করতে গিয়েছিল। এর একটি সালাউদ্দিন চালিয়েছেন, অন্যটি একরাম নামে আরেকজন।
সোহাগ চুরি করা মোবাইল কিনেছিলেন। তার হেফাজত থেকে মোবাইল উদ্ধার হওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত বেলাল ও একরাম এখনও পলাতক আছেন।
গ্রেফতার চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদে চমকপ্রদ তথ্য পাবার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চুরি করা নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার বিক্রি টাকা থেকে তারা প্রত্যেকে আড়াই লাখ টাকা করে পেয়েছে বলে জানিয়েছেন। তবে এটা আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। রিমান্ডে নিয়ে তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
‘আবুল কাশেম জানিয়েছেন, সে চুরির টাকা থেকে কোরবানির গরু কিনেন। তার বাবা একবছর আগে মারা গেছেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে তিনি ফাতেহা পাঠ ও ভোজের আয়োজন করেন। কয়েক’শ মানুষকে তিনি খাইয়েছেন। গ্রেফতার হেলাল চুরির টাকায় একটি মোটর সাইকেল কিনেছেন। হেলাল ও বেলাল- তারা দুই ভাইয়ের পেশা চুরি করা। জীবনে তারা চুরি ছাড়া আর কিছুই করেনি। চুরির টাকায় দুই ভাইয়ের সংসার চলে।’
এসআই কামাল আব্বাস আরও বলেন, ‘অটোরিকশা চালক সালাউদ্দিন চোরদের নিয়ে চুরির উদ্দেশে যাওয়াকে তার চাকরি বলে মনে করেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেন- আমি নিজে তো চুরি করিনি, আমি ভাড়া মেরেছি, এটা আমার চাকরি ; রাতে বের হই, সকালে আসি, হাজার দুয়েক টাকা পাই, যাত্রী চুরি করলো নাকি ডাকাতি করলো, সেটা আমার দেখার বিষয় নয়।’
সারাবাংলা/আরডি/এনইউ