।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: রাজধানীর আগারগাঁও এলাকার একটি সরকারি হাসপাতালের চিত্র- পুরো ওয়ার্ড জুড়ে নার্সরা কেবল গল্পই করেন। একবার কেন, এক শ’বার ডাকলেও তাদের পাওয়া যায় না। পাঁচ মাস বয়সী সন্তানকে নিয়ে এসে মেহেরবা তার এই অভিজ্ঞতার কথা জানান।
একই অভিজ্ঞতার কথা জানান, হাসিনা আহমেদ। ২৯ বছর আগে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেই সময়ের স্মৃতি এখনো স্পষ্ট তার। তিনি বলেন, চিকিৎসাধীন পুরোটা সময় দেখেছি- নার্সরা রোগীদের দিকে ফিরেও তাকান না।
পুরনো স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, রোগীটা কত চিৎকার করলো, স্বজনরা কত ডাকলেন- কিন্তু কে শোনে কার কথা! তারা নিজেদের মত করেই গল্প করে গেলেন। সারারাত কেউ এলেন না।
রাজধানীর বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালে কাজ করা নার্সদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ। নার্সেস স্টেশনে বসে গল্প করা, ফোনে কথা বলা, রোগীদের সময়মতো ওষুধ না দেওয়া, নিজেদের কাজ অন্যদের দিয়ে করানো। এর মধ্যে গ্রাম থেকে আসা স্বল্প শিক্ষিত-অস্বচ্ছল রোগীদের সঙ্গে তারা বেশি দুর্ব্যবহার করেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ৩৩ শতাংশ রোগী নার্সদের কাছে ভালো ব্যবহার পাননি। ১৬ শতাংশ রোগী জানিয়েছেন, নার্সদের থেকে নিয়মিত সেবা পাননি তারা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম একাধিকবার আহ্বান জানিয়েছেন, দেশের গরীর ও মধ্যবিত্ত মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল সরকারি হাসপাতাল। তাই হাসপাতালে আসা রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
চিকিৎসকরাও স্বীকার করেছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের নার্সিংয়ের মান খারাপ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য কামরুল হাসান খান এ বিষয়ে একাধিকবার কথা বলেছেন।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি রোগীদের সঙ্গে নার্সদের সর্ম্পক ভালো করার। রোগীরা যেন তাদের কথায় বা কাজে অসন্তুষ্ট না হন।
একটা কথা নার্সদের মনে রাখতে হবে, তারা যদি হাসিমুখে কথা বলেন তাহলে রোগীরা মানসিক প্রশান্তি পাবে। মানসিক প্রশান্তিই রোগীর আরোগ্যের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) এক চিকিৎসক এই প্রসঙ্গে বলেন, যারা হাসপাতালগুলোতে অনেক বছর ধরে রয়েছেন- তাদের বয়স হয়েছে। অনেক সময় পিএমএস (পোস্ট মেন্সট্রুয়াল সিনড্রোম) এবং মেনোপজের কারণে তাদের নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা যায়। এক্ষেত্রে আসলে তার নিজের কিছু করার নেই, এটা অন্যান্য শারীরিক জটিলতার মতো একটি প্রাকৃতিক জটিলতা।
তবে বিপরীত অভিযোগের পাল্লাও হালকা নয়। নার্সরা বলছেন, একজন ডাক্তারকে কতক্ষণ কাছে পান রোগীরা! ডাক্তার আসেন, রাউন্ড দেন, ফাইল দেখেন- আমাদের অর্ডার দিয়ে চলে যান। পুরো সময় রোগীর পাশে আমরাই থাকি। অথচ অভিযোগের আঙ্গুল সব সময় আমাদের দিকে।
কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের সিনিয়র নার্স ও বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন বক্ষব্যাধী হাসপাতাল কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক লিলি বেগম বলেন, রোগীর স্বজনরা নার্সদের মানুষই মনে করে না! শাসিয়ে যায়, রাজনৈতিক পরিচয় এখন বেশি ব্যবহার হচ্ছে। ‘তুই’ সম্বোধন করে। আমাদের যতটুকু ওষুধ-ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করা হয়, তার মধ্যে আমাদের ম্যানেজ করতে হয়। যখন রোগী তার চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ পায় না, তখন স্বজনরা আমাদের ওপর চড়াও হয়। বিশেষ করে তরুণরা। অথচ শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরাও ভাবে না, কর্মকর্তাদের নির্দেশের বাইরে আমরা যেতে পারি না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্সিং সুপারভাইজার সান্ত্বনা রানী দাস সারাবাংলাকে বলেন, আমরাওতো মানুষ। আমাদেরও নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারপরও আগের চেয়ে রোগী ও নার্সের সর্ম্পক অনেক ভালো হয়েছে, যেটা কয়েকবছর আগেও ছিল না।
সারাবাংলা/জেএ/এটি
** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে সারাবাংলার ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: Sarabangla/Facebook