কুবিতে সাংবাদিক বহিষ্কার, নিন্দার ঝড়
৩ আগস্ট ২০২৩ ২৩:৪১
কুমিল্লা: দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ইকবাল মুনাওয়ারকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের ঘটনায় দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে।
জানা যায়, গত সোামবার মার্কেটিং বিভাগের এক অনুষ্ঠানে কুবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন দুর্নীতি নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। সেই বিতর্কিত মন্তব্য কোড করে সংবাদ পরিবেশন করেন কুবি সাংবাদিক সমিতির সদস্য ইকবাল মুনাওয়ার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দৈনিক যায়যায়দিনের প্রতিনিধি ইকবাল মুনাওয়ারকে বহিষ্কার করে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ উল্লেখ নেই রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত ঐ বিজ্ঞপ্তিতে।
বহিষ্কারাদেশটি সোশ্যাল মিডিয়ায় (ফেসবুক) ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে দেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, সংবাদকর্মী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ বিবৃতির মাধ্যমে নিন্দা জ্ঞাপন করতে দেখা যায়।
সংবাদ মাধ্যমের বরাতে বিবৃতিতে বলা হয়, গত ৩১ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের নবীনবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন দুর্নীতি নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করেন। পরে তার বক্তব্য উদ্ধৃত করে দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এদিকে, ২ আগস্ট কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অফিস আদেশে দেখা যায়, উপাচার্যের বক্তব্যকে ‘বিকৃত করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তিমূলক মিথ্যা তথ্য প্রচারে’র অভিযোগের সংশ্লিষ্ট সংবাদকর্মী ইকবাল মুনাওয়ারকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কারাদেশটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্তব্যরত সাংবাদিকেদের মধ্যে। তারা এ বহিষ্কারাদেশ বেআইনি উল্লেখ এবং বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিতে দেখা যায়।
বহিষ্কারাদেশ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদিক সংগঠন নিন্দা জ্ঞাপন করে বিবৃতি দিতে দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (ডুজা), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (জাবিসাস), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (চবিসাস), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (রাবিসাস), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (খুবিসাস), শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যাল সাংবাদিক সমিতি, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (কুবিসাস), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (জবিসাস), এডুকেশন রিপোর্টার্স ইউনিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জার্নালিস্ট ইন ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়াসহ দেশের বিভিন্ন পেশাজীবী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন উদ্বেগ, নিন্দা এবং অনতিবিলম্বে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করেছেন।
আইনবহির্ভূত পন্থায় বহিষ্কার করায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (ডুজা)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি বিবৃতিতে জানায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি দুর্নীতির পক্ষে বক্তব্য দেওয়া মানে তিনি দুর্নীতি করাকে উৎসাহিত করেছেন। যেটি দেশের আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। সেই বক্তব্যের জন্য তার জাতির সামনে ক্ষমা চাওয়া উচিত। এটি না করে বরং তিনি একজন সাংবাদিককে কোন ধরনের আইনের তোয়াক্কা না করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছেন। তিনি ওই সংবাদকর্মীর পেশা জীবনে সংঘটিত ঘটনার প্রতিক্রিয়া তার শিক্ষা জীবনের উপর দেখিয়েছে, যা কোনো বিচারেই যুক্তিযুক্ত নয়।
ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত মিনহাজ ‘আরেকটি গাভী বৃত্তান্তের গল্প’ নামের কলাম লেখেন। এতে দুর্নীতির বিষয়ে উপাচার্যের বক্তব্য এবং বহিষ্কারাদেশের সমালোচনা করেন তিনি। কলামটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলেতে প্রকাশিত হয়।
বহিষ্কারাদেশ নিঃশর্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকরা। একই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে মানববন্ধন করেছেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা।
এ বিষয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির (কুবিসাস) সভাপতি মুহা. মহিউদ্দিন মাহি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনরকম আইনের তোয়াক্কা না করে এবং কোনো বিধি না মেনে ইকবালকে বহিষ্কার করেছে। সাংবাদিক সমিতি মনে করে সংবাদ প্রকাশ কোনো অপরাধ নয়। যে সংবাদের জন্য ইকবালকে বহিষ্কার করা হয়েছে সে সংবাদের সব তথ্য প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। প্রশাসন বলেছে উচ্চপর্যায়ের সভার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু কারা এই উচ্চপর্যায়ের সভায় আছেন এবং কোন শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে ইকবালকে বহিষ্কার করেছেন তার কিছুই উল্লেখ করেননি প্রশাসন। আমরা আজকের মধ্যে এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার চাই অন্যথায় আগামী রবিবার পুরো বাংলাদেশের সাংবাদিকদের নিয়ে কঠোর আন্দোলন করতে বাধ্য হবো।’
ছাত্র ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক রকিবুল রনি মানববন্ধনে বলেছেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যে বক্তব্য দিয়েছে তা কোনো মিটিং বা বৈঠকে দেন নাই। শতশত শিক্ষার্থীর সামনে তিনি কীভাবে দুর্নীতি নিয়ে উৎসাহিত করেন। ওনার কথা হলো তোমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসো উচ্চ শিক্ষিত হও, আর চাকরির বাজারে গিয়ে দুর্নীতি করো। এইরকম একজন মানুষ কীভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়! আপনি ভরা মজলিসে বক্তব্য দিবেন আর সাংবাদিক সেটি প্রকাশ করলে দোষ। আর এটি প্রকাশ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে? আপনি এত মানসম্মান নিয়ে কেন এই চেয়ারে বসলেন? আপনি ইকবালের বহিষ্কারাদেশ অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করবেন। না হয় ছাত্র ইউনিয়ন এবং সাংবাদিকরা বসে থাকবে না।
দেশের সব (প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন) জাতীয় গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশের জেরে শিক্ষার্থী বহিষ্কারের সংবাদটি জোরালোভাবে প্রকাশ করা হয়।
ইকবালকে বহিষ্কারের নিন্দা জানিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘তথ্য প্রকাশের কারণে একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা ‘শ্যুট দ্য মেসেঞ্জার’ বা বার্তা বাহককে স্তব্ধ করার চর্চার উদাহরণ। একই সঙ্গে এটি ক্ষমতার অপব্যবহারের পরিচায়ক। যা অযৌক্তিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত এই প্রতিশোধমূলক ও অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিঃশর্ত প্রত্যাহার করা।’
সারাবাংলা/একে