সাড়ে ৪২ কোটির প্রকল্পের ১৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকাই পরামর্শ খাতে!
৬ আগস্ট ২০২৩ ১০:৩০
বৈদেশিক ঋণের প্রকল্পে বাধ্যতামূলক পরামর্শক নেওয়া নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবার একটি প্রকল্পের পরামর্শ খাতের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনুদান দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। ৪২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার প্রকল্প। যার ১৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয় হবে পরামর্শক খাতে ( যা প্রকল্পের প্রায় ৪০ দশমিক ৮৪ শতাংশ)।
‘ফিশারিজ লাইভলিহুড ইনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট ইন দ্য কোস্টাল এরিয়া অব দ্য বে অব বেঙ্গল (এফআইএলইপি)’ শীর্ষক প্রকল্পে এমন প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ব্যয় নিয়ে আপত্তি তুলতে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন।
আগামীকাল সোমবার (৭ আগস্ট) বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (এসপিইসি) একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) একেএম ফজলুল হক। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে এক কোটি ৩ লাখ টাকা এবং জাইকার অনুদান সহায়তা থেকে ৪১ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে।
উন্নয়ন প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয় প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, বিদেশি ঋণ বা অনুদান নিয়ে তাদের শর্ত অনুযায়ী কিছু পরামর্শক নিতেই হয়। কিন্তু তাই বলে আমাদের ক্ষতি হবে এমন শর্ত মেনে নেওয়া যায় না। আলোচনার মাধ্যমে নিশ্চয়ই এই খাতে ব্যয় যৌক্তিক করবে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দেশে মোট অভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপাদন প্রায় ৪ দশমিক ৭৫৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন। যেখানে অভ্যন্তরীণ খোলা জল বা অভ্যন্তরীণ ক্যাপচার মৎস্য উৎপাদন ১ দশমিক ৩২২ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং অভ্যন্তরীণ কাছাকাছি জল বা সংস্কৃতি (জলজ চাষ) উৎপাদন ২ দশমিক ৭৩১ মিলিয়ন মেট্রিক টন। মোট সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন প্রায় শূন্য দশমিক ৭০৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। মোট মাছ উৎপাদনের সামুদ্রিক খাত অবদান রাখে। মোট সামুদ্রিক মাছ ধরার মাত্র ১৯ দশমিক ৪০ শতাংশ বাণিজ্যিক মাছ ধরার জাহাজ বা বৃহৎ শিল্প মাছ ধরার অবদান রাখে এবং বাকি ৮০ দশমিক ৫৯ শতাংশ আসে কারিগরের ছোট আকারের মাছ ধরা থাকে।
দেশে ছোট আকারের মৎস্যচাষের (এসএসএফ) কোন প্রতিষ্ঠিত সংজ্ঞা না থাকলেও কারিগর শব্দটি প্রায়ই তাদের বৈশিষ্ট্য ছোট আকারের মৎস্য সম্পদ নির্দিষ্ট করতে ব্যবহৃত হয়। প্রায় ২৪ হাজার ৮০০ নটিক্যাল মাইল (এনএম) অগভীর জলের শাসনের কারণে দেশের উপক‚লরেখা ছোট আকারের মৎস্য চাষের জন্য আদর্শভাবে উপযুক্ত। এসএসএফ দেশের খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা, লাখ লাখ দরিদ্র পরিবারের আয় ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে।
যদিও দেশের সামুদ্রিক মৎস্য খাত কম বেশি বাণিজ্যিক ট্রলারের দিকে মনোনিবেশ করেছে। যদিও ছোট আকারের কারিগর মৎস্য সামুদ্রিক মাছ ধরার ৮১ শতাংশ অবদান রাখে। তাই ছোট আকারের জেলেরা অনিয়ন্ত্রিত এবং অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরার নেতৃত্ব দিয়েছিল যা প্রায় ৪০ মিটার গভীরতার রেঞ্জের উপক‚লীয় জলে মাছের মজুদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, কক্সবাজার দেশের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত এলাকাগুলির মধ্যে একটি যেখানে জেলার প্রায় ৩৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে এবং ১৭ শতাংশ চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। সম্প্রতি মিয়ান থেকে আসা এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে যা স্থানীয় আয়োজক সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অতিরিক্ত আর্থ-সামাজিক বোঝা চাপিয়েছে।
বেশিরভাগ হোস্ট সম্প্রদায় তাদের জীবন যাত্রার জন্য কৃষি ও মৎস্য চাষের উপর নির্ভরশীল, কক্সবাজারের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ২৮ শতাংশ মাছ ধরা এবং এর সাথে সম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপগুলির সাথে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে কারণ উদ্বাস্তুদের অতিরিক্ত চাহিদা খাদ্য, শাকসবজি, ফল, মাছ এবং মাংসের পাশাপাশি পরিবহণ যা কোভিড-১৯ এর মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল এবং জীবিকার সুযোগ হ্রাস সহ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলির খরচ বাড়িয়েছে।
প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ফসল আহরণ উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। তারই ফল হিসেবে মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের জীবন জীবিকার অবস্থার অবনতি ঘটছে নাফ নদীতে সম্পূর্ণ মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা এবং ৬৫ দিনের সামুদ্রিক মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা, হোস্ট সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার অবনতিকে আরও তীব্র করেছে। টেকসই প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জীবিকার উন্নতি, বিকল্প আয় সৃষ্টিকারী উদ্যোগের দ্বারা সমর্থিত হওয়া প্রয়োজন। উপকূলীয় মাছ ধরার সম্প্রদায়ের বর্তমানে সংগঠন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি এবং স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করার ক্ষমতার অভাব রয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলো জটিল এবং বহুমাত্রিক।
দরিদ্র মৎস্যজীবিদের টেকসইজীবিকা নির্বাহের জন্য যেকোন সহায়তার জন্য মৎস্যজীবীদের বর্তমান প্রতিক‚ল অবস্থা থেকে বের করে আনতে সামগ্রিকভাবে মনোনিবেশ করতে হবে। প্রকল্প চলাকালীন সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে ছোট আকারের কারিগর মাছ ধরার পরিবারের অন্তর্ভুক্তিমূলক জীবিকা ও পুষ্টির অবস্থা এবং স্থিতিস্থাপকতা উন্নত বলে আশা করা হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের মতামত: ৪২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার প্রকল্পে পরামর্শক খাতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ( প্রায় ৪০ দশমিক ৮৪ শতাংশ), যা অত্যধিক প্রতীয়মান হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনর কাছে। এ বিষয়ে ব্যাখা চাওয়া হবে এসপিইসি সভায়।
এছাড়া প্রকল্পটি কক্সবাজার জেলার ৫টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হবে। এ এলাকার মৎস্যজীবিদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য সাসটেইনেবল মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এনবিএফ) কাজ করছে। এ অবস্থায় একই এলাকায় একই উদ্দেশ্য দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে কাজে দ্বৈততা এবং প্রকল্পের বাস্তবায়নোত্তর পর্যায়ে প্রকল্প গুলোর ফলাফল নিরুপনে জটিলতার সৃষ্টি হবে কিনা সে বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের মতামত জানতে চাওয়া হবে।
আরও জানা যায়, প্রস্তাবিত টিএপিপির অধিকাংশ অঙ্গের ব্যয় থোক হিসাবে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ সব ব্যয় প্রাক্কলনের বিস্তারিত বিভাজন মৎস্য অধিদপ্তর সভায় উপস্থাপন এবং বিস্তারিত আলোচনা করে পুন:নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন।
সারাবাংলা/জেজে/এনইউ