দ্বাদশের ভোটযুদ্ধে জিততে শপথ নিল তৃণমূল আওয়ামী লীগ
৬ আগস্ট ২০২৩ ২০:০৩
ঢাকা: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের লক্ষ্যে ভোটযুদ্ধে শামিল হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দ্বাদশের ভোটযুদ্ধে নৌকার জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার লক্ষ্যে তূণমূলের হাজারো নেতা বিভেদ ভুলে নৌকার পক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার শপথ নিলেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আগামী নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর জয়ে কাজ করতে হাত তুলে অঙ্গীকার করেন তৃণমূলের প্রতিনিধিরা। করোনা অতিমারির পর এবারই প্রথম একসঙ্গে তৃণমূলের এত নেতা ও জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে সরগরম হয় গণভবনের আঙিনা।
রোববার (৬ আগস্ট) সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা শুরু হয়ে দুপুরে শেষ হয়। ‘শত সংগ্রামে অজস্র গৌরবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে’ আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এই বিশেষ বর্ধিত সভা হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সভায় সভাপতিত্ব করেন। ১ম পর্বে সভা পরিচালনা করেন দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম।
সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন দলের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্যের পর বিভাগওয়ারী তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য শুরু হয়। এ সময় সভা পরিচালনা করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সভার শুরুতে ১৫ আগস্ট কালরাতে নিহত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সমাপনী বক্তব্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের একমাত্র শক্তি জনগণ। আমরা কারও কাছে মাথা নত করি না। বিএনপির জন্মই হচ্ছে আজন্ম পাপ। বিএনপির জন্ম অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে, জাতির পিতার হত্যার মধ্য দিয়ে ও সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলে। প্রত্যেকটা এলাকায় যা যা উন্নয়ন হয়েছে মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে, প্রচার করতে হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাকে মনোনয়ন দিবে তাকে জয়যুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে।’
সভায় উপস্থিত নেতারা জানান, তৃণমূল নেতাদের মান-অভিমানের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় এমপি ও মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতাদের নিজেদের মধ্যে কুৎসা বিষোদাগার না করে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা নিজেদের মধ্যে প্রকাশ্যে কোনো কুৎসা-বিষোদাগার করবেন না। সরকারের আর্থসামাজিক অগ্রগতি উন্নয়ন অর্জনের কথা জনগণের কাছে তুলে ধরবেন। জনগণের কাছে যান, তাদের ভালবাসা অর্জন করুন। জনগণের ভালবাসা অর্জন করেই ভোটের মাধ্যমে জিততে হবে। অন্যভাবে কারও জেতার সুযোগ নেই। আমি বিভিন্ন সংস্থা মারফত প্রতি ছয় মাস অন্তর অন্তর তৃণমূলের জরিপ সংগ্রহ করে রাখছি। জনগণের কাছে অধিক জনপ্রিয় গ্রহণযোগ্যই মনোনয়ন পাবেন। কানা-খোড়া-ল্যাংড়া যাকেই নৌকা দিব আপনারা তার পক্ষ্যেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন। আর না কাজ করলে ২০০১ সালের মতো পরিণতি হবে। কেউ ঘরবাড়িতে থাকতে পারবেন না।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি আরও বলেন, ‘আপনারা ভোটের মাঠে নৌকার পক্ষ্যে কাজ করবেন- শপথ নেন এবং আমাকে কথা দেন?’ এ সময় উপস্থিত তৃণমূল প্রতিনিধিরা দুই হাত তুলে দ্বাদশের ভোটের মাঠে দলীয় প্রার্থীর পক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
করোনা অতিমারির পর গণভবনে এই প্রথম তৃণমূলের প্রায় তিন হাজারের অধিক তৃণমূল প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আজকের বিশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সাংগঠনিক মান-অভিমান দলীয় সংসদের সঙ্গে নেতাদের সমন্বয়হীনতাসহ নানা বিষয়ে মন খুলে কথা বলেন তৃণমূলের নেতারা। আওয়ামী লীগ সভাপতি নিজ হাতে চিরকুট লিখে প্রতিনিধির মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়ে নেতাদের বক্তব্যের সুযোগ করে দেন। সারাদেশ থেকে প্রায় ৪৩ জন তৃণমূল প্রতিনিধি বর্ধিত সভায় বক্তব্য দেন।
পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমাদের দলীয় এমপি জেলার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে না। উনার টিআর-কাবিখা তথা উন্নয়ন বরাদ্দগুলো কাকে কোথায় দেয় সেটাও আমরা জানতে পারি না। আমরা নেতা, আমাদের হাতে কোনো সরকারি বরাদ্দ নাই। এ বিষয়ে আপনি দৃষ্টি দেবেন।’ দলীয় সংসদ সদস্যদের সমন্বয়হীনতার বিষয়ে একই ধরনের অভিযোগ করেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনও।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান বলেন, ‘নেত্রী আপনি তো বাগানে শত ফুল ফোটার কথা বলেছেন। কিন্তু বড় বড় নেতা তো বাগানে ভালো ফুল ফুটতে দিতে চান না। ভালো ফুলকে বোঁটা থেঁকে ছিড়ে ফেলতে ষড়যন্ত্র করেন। আপনি এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। আপনার আরও নজর দেওয়া দরকার।’ একই অভিযোগ করেন নোয়াখালী জেলা অধ্যক্ষ এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী।
কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতা না করে সেখানে নৌকার প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ার আহ্বান জানান তাড়াইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আজিজুল হক মোতাহার। ঝিনাইদহ কোটচাঁদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুন্নেছা মিকি বলেন, ‘নেত্রী আপনি আমাদের মনোনয়ন দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। কিন্তু ইউএনও-ওসিরা কোনো দাম দিতে চায় না। আমাদের কথার কোনো মূল্য তারা দেন না। আপনি একটু আমাদের (উপজেলা চেয়ারম্যান) অধিকার দেন।’ আওয়ামী লীগ সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বিএনপি-জামায়াতের নির্যাতনে স্বামী হারা শরিফুন্নেছা মিকি।
পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কানাই লাল বিশ্বাস তাকে ভারমুক্ত করার আহ্বান জানালে আওয়ামী লীগ সভাপতি সারাদেশে যারা ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে তাদের সবাইকে ভারমুক্ত করা হলো বলে ঘোষণা দেন। সিলেট বিভাগের নেতারা ভূমিহীন-গৃহহীনদের জমিসহ ঘর উপহার বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেন না বলে অভিযোগ করেন।
তৃণমূল প্রতিনিধি হিসেবে আরও কথা বলেন দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলতাফুজ্জামান মিতা, পঞ্চগড় জেলার সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাট, রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অনিল কুমার সরকার, সিরাজগঞ্জ জেলার সভাপতি কে এম হোসেন আলী হাসান, বগুড়া জেলা সভাপতি মজিবর রহমান মজনু, ঢাকা জেলার সাধারণ সম্পাদক পনিরুজ্জামান তরুণ প্রমুখ।
বিশেষ বর্ধিত সভায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা, জেলা ও মহানগর, উপজেলা, থানা, পৌর (জেলা সদরে অবস্থিত পৌরসভা) আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় সংসদের দলীয় সদস্য, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের দলীয় চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার দলীয় মেয়র এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন।
সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম