চট্টগ্রাম জুড়ে রেকর্ড বৃষ্টি, শহরের পাশাপাশি প্লাবিত গ্রামও
৬ আগস্ট ২০২৩ ২৩:০৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বর্ষার শেষভাগে টানা বর্ষণে চট্টগ্রাম নগরী পানিবন্দি হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি জেলায় নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামও পানিতে তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে ফসলের ক্ষেত ও পুকুর। বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ধসের শঙ্কায় বাসিন্দাদের সরে যেতে মাইকিং করেছে স্থানীয় প্রশাসন। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জেলা প্রশাসনের কমকর্তারা।
গত বৃহস্পতিবার (০৩ আগস্ট) সন্ধ্যা থেকে চট্টগ্রাম নগরীসহ আশপাশের এলাকায় বৃষ্টিপাত শুরু হয়। শনিবার রাত থেকে শুরু হয় অতি ভারী বর্ষণ। আবহাওয়া অফিস অতি ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির অবনতি ও পাহাড়ধসের সতর্কতা জারি করে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস রোববার (৬ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টায় পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে, যা গত ৩০ বছরে রেকর্ড। এ সময় আমবাগান আবহাওয়া অফিস ২১২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে।
রোববার রাত ৯টা পর্যন্ত পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ২৮৯ দশমিক ৮ মিলিমিটার এবং আমবাগানে ২১৪ দশমিক ৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়। চলতি বছরে এ পরিমাণ বৃষ্টিপাতও রেকর্ড বলে জানিয়েছেন পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ উজ্জ্বল কান্তি পাল। এ ছাড়া রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ১৮ মিলিমিটার এবং আমবাগানে ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে।
রোববার দিনভর টানা বর্ষণে সাতকানিয়া, বাঁশখালী, চন্দনাইশ, হাটহাজারী, সাতকানিয়া এবং রাউজান উপজেলার নিচু এলাকায় লোকালয়ে পানি উঠে গেছে। এতে কয়েক’শ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এসব উপজেলার পাশাপাশি বোয়ালখালী ও রাঙ্গুনিয়ায় ফসলের ক্ষেত ও পুকুর পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে বীজতলা ও নতুন রোপণ করা ধানের চারা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মাছও পুকুর ছেড়ে গেছে।
জানা গেছে, পাহাড়ি ঢলে চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চনাবাদ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের একটি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। সেখানে অন্তত ৩০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কাঞ্চনাবাদসহ আরও কয়েকটি গ্রামে ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে।
চন্দনাইশ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা জিমরান মোহাম্মদ সায়েক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাপক আকারে না হলেও কিছু মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আমরা ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেছি। দুই/তিনটি ইউনিয়নে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে অনেকে বসবাস করছেন। তাদের সরে যাবার জন্য মাইকিং করা হয়েছে। কিন্তু উনারা যাচ্ছেন না। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে কাল (সোমবার) আমরা তাদের জোরপূর্বক সরিয়ে দেব।’
চন্দনাইশ থানা পুলিশের এক বিজ্ঞপ্তিতে উপজেলার শঙ্খ নদীসহ বিভিন্ন খালপাড়ে এবং বিভিন্ন পাহাড় ও টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরে যাবার অনুরোধ করা হয়েছে। অতিবর্ষণে গাছ পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বৈদ্যুতিক তারে হাত না দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে থানার ডিউটি অফিসারের (০১৩২০১০৭৮৯১) সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বলা হয়েছে।
সাতকানিয়া উপজেলার চরতী ও আমিলাইষ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ও ফসলের ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাঞ্চনা, এওচিয়া, বাজালিয়া ইউনিয়নে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী শতাধিক মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুটি ইউনিয়ন প্লাবিত হলেও সড়ক যোগাযোগ ঠিক আছে। পাহাড় থেকে স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বাররা মিলে অনেক পরিবারকে সরিয়ে নিয়েছে। তারা আত্মীয়স্বজনের বাসায় চলে গেছে।’
বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়া ও সাধনপুর ইউনিয়নের সাগরসংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সেখানে বিস্তির্ণ এলাকায় এবং পাহাড়ে ফসল ও সবজিক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাঁশখালীর ইউএনও সাইদুজ্জামান চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘জোয়ারের পানি এলে দু’টি ইউনিয়নের যেখানে বেড়িবাঁধ দুর্বল সেখানে পানি উঠে যাচ্ছে। তবে জোয়ার চলে গেলে আবার পানি নেমে যাচ্ছে। বলা যায়, দুই ইউনিয়নে শ’খানেক পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় আছে। ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় বীজতলা ও নতুন রোপণ করা চারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সাধনপুরে দেয়াল ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।’
রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শস্যভাণ্ডার খ্যাত গুমাই বিল পানিতে তলিয়ে গেছে। আশপাশের বীজতলা, ফসলের ক্ষেতও প্লাবিত হয়েছে। রাঙ্গুনিয়ার ইউএনও আতাউল গণি ওসমানী সারাবাংলাকে বলেন, ‘লোকালয়ে এখনও পানি আসেনি। তবে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। বেশি শঙ্কায় আছি পাহাড়ি ঢল নিয়ে। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে অনেককে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।’
সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সম্রাট খীসা সারাবাংলাকে বলেন, ‘জোয়ারের পানিতে ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। এখন বেশিরভাগ বীজতলা, সেগুলো নষ্ট হচ্ছে। কিছু কিছু জমিতে চারা রোপণ করা হয়েছে, সেগুলো পানিতে ডুবে আছে। এছাড়া সাগরে, নদীতে জোয়ার বেশি হওয়ায় অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।’
হাটহাজারী উপজেলার উত্তর বুড়িশ্চর, বোয়ালখালীর সারোয়াতলী, শাকপুরা, আমুচিয়া, পোপাদিয়ার বিস্তির্ণ ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। অধিকাংশ এলাকায় পুকুরের মাছ চাষীরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে, টানা বর্ষণে রোববার দিনভর নগরীর অধিকাংশ এলাকাও পানিতে তলিয়ে যায়। সিটি করপোরেশন নগরীতে পানিবন্দি ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করা জালালাবাদ, পশ্চিম ষোলশহর, উত্তর পাহাড়তলী, পুর্ব পাহাড়তলী, লালখান বাজার ও চকবাজার ওয়ার্ডের ৩০০ পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণভাবে থাকা মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ এলাকায় সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘অনেকে পাহাড় ধসের ঝুঁকি থাকার পরও পাহাড়ের উপরে ও পাদদেশে বসবাস করছেন। এভাবে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুকিপূর্ণভাবে বসবাস করা জনগণের প্রতি আহবান আপনারা আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যান। আপনাদের জন্য খাবার, স্বাস্থ্যসেবা থেকে সবকিছু প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আমরা পানিবন্দি এলাকাগুলোতে বিতরণের জন্য ১০ হাজার মানুষের জন্য খাবার প্রস্তুত রেখেছি।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গত দু’দিনে এক হাজারের বেশি পরিবারকে বিভিন্ন পাহাড় থেকে সরিয়ে নিয়েছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ উজ্জ্বল কান্তি পাল সারাবাংলাকে জানান, মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার কারণে অতি ভারী বৃষ্টিপাত সোমবারও অব্যাহত থাকবে। ৯ আগস্ট থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমতে পারে। সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত এবং নদীবন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম