‘সেঞ্চুরির রেকর্ড’ গড়তে যাচ্ছে সাগর-রুনি হত্যা মামলা
৭ আগস্ট ২০২৩ ০৮:৩৭
ঢাকা: ‘আগামীকাল মামলার সুবর্ণজয়ন্তী হতে যাচ্ছে। কি আর বলবো, রেকর্ড তৈরি করতে যাচ্ছে সাগর-রুনির হত্যা মামলা। আমি এখন পর্যন্ত আমার ছেলের কবর জিয়ারত করতে যাইনি। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, যেদিন আমার ছেলের হত্যাকারীদের দেখবো, বিচার দেখে যেতে পারবো, ওইদিন কবর জিয়ারত করবো। এর আগে যদি আমার মৃত্যুও হয়, হোক। এরপরও খুনিদের না দেখে আমি ছেলের কবর জিয়ারত করতে যাবো না।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে কথাগুলো বললেন সাংবাদিক সাগর সারোয়ারের মা সালেহা মনির। সাংবাদিক দম্পতি খুন হওয়ার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের ধরার প্রতিশ্রুতির এগারো বছরের বেশি সময় পার হলেও ছেলে হত্যার বিচার পাননি তিনি।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করছে র্যাব। এখন পর্যন্ত ৯৯ বার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তদন্ত শেষ হয়নি।
গত ২২ জুন মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ছিল। কিন্তু ওইদিন র্যাব প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রট শফি উদ্দিনের আদালত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ৭ আগস্ট ধার্য করেন। আজ সোমবার (৭ আগস্ট) র্যাব প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারলে প্রতিবেদন দাখিল পেছানোর সেঞ্চুরি হবে।
সাংবাদিক সাগর সারোয়ারের মা সালেহা মনির বলেন, ‘মামলার তদন্ত কি হচ্ছে গত ৩/৪ বছর ধরে আমি কিছুই জানি না। কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত রাখেনি। এখন তদন্ত কর্মকর্তা কে আসেন তাও চিনি না। সাগরের মা যে বেঁচে আছে, ছেলে বেঁচে আছে এখানকার কর্মকর্তা মনে হয় জানেন না। আমার ছেলেকে তো আর ফেরত পাবো না, এজন্য বিচার চাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমার একটাই কথা, ছেলে হত্যার বিচার চাই। আমার মৃত্যুর আগে হলেও দেখে যেতে চাই সাগর-রুনির হত্যাকারীদের বিচার। এর আগে যদি আমার মৃত্যুও হয়, হোক। এরপরেও খুনিদের না দেখে আমি ছেলের কবর জিয়ারত করতে যাবো না।’
সাগর-রুনির ছেলে মেঘের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ও এখন আমার অনেক খোঁজ খবর রাখে মেঘ। আমার কোলে এসে শুয়ে থাকে। মেঘ এখন ফুফুর হাতে ছাড়া ভাত খায় না। আমার ছেলে এভাবে মারা যাবে, চলে যাবে কল্পনাও করতে পারেনি। আবার মামলা যে এতো দেরি হবে, এই সরকারের আমলেই সেটাও ভাবতে পারিনি। র্যাব তো সব জানে। প্রতিবেদন জমা দিলেই হয়। সোজা কথা আমার ছেলের খুনিকে দেখে যেতে চাই। তাদের শাস্তি হবে কিনা জানি না। তবে খুনিদের দেখে যেতে চাই, কেন আমার ছেলেকে খুন করলো, কিসের জন্য করেছে। একটা মায়ের মনে আর কি আকুতি থাকতে পারে। কত খুনের বিচার হচ্ছে, ক্লু-লেস কত মামলায় বিচার হচ্ছে। কিন্তু সাগর-রুনির বেলায় এমন হচ্ছে কেন আমার বোধগম্য নয়।’
মামলার বাদী মেহেরুন রুনির ছোট ভাই নওশের আলম রোমান সারাবাংলাকে জানান, ‘১০০ বারেও মামলার প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারলে, এটা শুধু আমাদের ক্ষেত্রে নয়, সারাদেশের বিচার ব্যবস্থার জন্য লজ্জাজনক কথা। সরকার চাইলে সত্য ঘটনা বের করতে পারেন। সেখানে ১০০ বার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় চেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা, আর সেই সময়ও মঞ্জুর হচ্ছে। অথচ তারা এলিট ফোর্স দাবি করেন। সেখানে সাধারণ মানুষ কার কাছে বিচার চাইবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘আরও দুঃখজনক বিষয় তারা ছোট বিষয়গুলো নিয়ে বড় করে প্রেস ব্রিফিং করে। অথচ আলোচিত এই ঘটনা নিয়ে কোনো কাজ দেখাতে পারলো না। গত ১২ বছর ধরে মামলাটির প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় চেয়ে নিচ্ছে এটা একটি লজ্জাজনক বিষয়। আমরা চাই প্রকৃত অপরাধী বের হয়ে আসুক, আর বাংলাদেশি আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি হোক। আমাদের এটাই দাবি।’
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের বছর ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুনি নিজ ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। ওইদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘটনাস্থলে এসে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করার কথা বলেছিলেন।
২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্তের জন্য প্রথম ডিবি উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলম তদন্ত ভার নেন। এরপর ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, ওই বছরের ৭ জুন, ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর ও সর্বশেষ ২০১৭ বছরের ২১ মার্চ তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তদন্ত অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রতিটি প্রতিবেদনে প্রায় একই ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার ৮ আসামির দু’জন বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল ও কথিত বন্ধু তানভীর রহমান জামিনে আছেন। অপর ৬ আসামি মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু, বকুল মিয়া, কামরুল হাসান অরুন, রফিকুল ইসলাম, এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবিল ও আবু সাঈদ কারাগারে। এ মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার ৮ জনের কেউই এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেননি।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল হক ও পলাশ রুদ্র পাল ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেন। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ ও নিহত দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান- এই ৫ জনকে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র হত্যার ঘটনায় র্যাব ও ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। এখন পর্যন্ত মামলায় ১৫৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে র্যাব।
সারাবাংলা/এআই/এমও