Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আশ্রয়ণ প্রকল্প: হাসি ফুটেছে মিতুলদের মুখেও

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৯ আগস্ট ২০২৩ ০১:৩৮

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের সামনে মিতুল, রবিন, সৃজনী। ছবি: হাবিবুর রহমান

পাবনা থেকে: “আগে সদরে এক জায়গায় একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতাম। কিন্তু অন্য ফ্ল্যাটের যারা আছে তারা বলে, ‘এখানে থাকা যাবে না।’ বাড়ির মালিকও বেশি দিন থাকতে দেয়নি আমাদের। এরকম সব জায়গাতেই আমাদের হেনস্থা হতে হয়েছে। কিন্তু এইখানে কেউ বলতে পারে না, ‘ওরা থাকলে আমরা থাকব না।’ এখন আর কথা শোনানোর কেউ নাই। আমরা অনেক ভালো আছি।”

কথাগুলো বলতে বলতেই মিতুলের চোখের কোণে উঁকি দেয় অশ্রুর ফোঁটা। তবে সে অশ্রু বেদনার নয়, আনন্দের। বছরের পর বছর সবার কাছ থেকে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করার যে কষ্ট, সেই কষ্ট থেকে যে মুক্তি পেয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের এই নাগরিক। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের কল্যাণে এখন পেয়েছেন নিজেদের ঘর। তার ছোঁয়াতেই বদলে গেছে তাদের জীবন। মিতুলরাও এখন হাসতে পারেন মন খুলে, নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারেন জোর গলায়। তার জন্য কারও আপত্তিও শুনতে হয় না।

বিজ্ঞাপন

পাবনার হেমায়েতপুরে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১০টি ঘর পেয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের ১২ জন। তারা বলছেন, এই প্রকল্পে কেবল মাথা গোঁজার ঠাঁই-ই নয়, পেয়েছেন আয়-রোজগারের পথও। হাস-মুরগি ও গবাদি পশু পালন তাদের আয়ে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। কেউ বাড়ির আঙিনায় চাষ করেছেন শাক-সবজি। কেউ শুরু করেছেন হস্তশিল্পের কাজ। মিতুল, রবিন, সৃজনীরাই বলছে, আশ্রয়ণ প্রকল্প তাদের জীবন বদলে দিয়েছে।

মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) পাবনা সদরের হেমায়েতপুর আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা মেলে মিতুলদের। আজ বুধবারই (৯ আগস্ট) ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হেমায়েতপুরের মতোই পাবনার বেড়া উপজেলার চাকলা আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৫০টি ঘর উপকারভোগীদের মধ্যে হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে দেশের ১২টি জেলার সব উপজেলাসহ ১২৩টি উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা দেবেন তিনি। এদিন মোট ২২ হাজার ১০১টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর হস্তান্তর করা হবে।

বিজ্ঞাপন

হেমায়েতপুরের আশ্রয়ণ প্রকল্পে কথা হয় তৃতীয় লিঙ্গের ‘গুরু মা’খ্যাত মিতুলের সঙ্গে। মিতুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন আমরা অনেক ভালো আছি। আমাদের ঘর ভাড়া দিতে হয় না। আমরা জোরে মন খুলে হাসতে পারছি, কথা বলতে পারছি। আমাদের কমিউনিটির মানুষের সঙ্গে মিশতে পারছি। আগে কোনো মেহমান আসলে বাসায় নেওয়া যেত না। বেশি মানুষ আসলে ভাড়াটিয়ারা কমপ্লেন দিত। বলত, অন্য লোক আসছে, ওরা সব সময় গ্যানজাম করে। এখন আর তা বলার সুযোগ নেই। এখন আমরা নিজেদের ঘরে থাকি। কথা শোনানোর কেউ নাই।’

আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘরের সামনের জায়গাটুকু নানা কাজে ব্যবহার করছেন উপকারভোগীরা। ছবি: হাবিবুর রহমান

শহরে ফ্ল্যাট নিয়ে কোথাও-ই বেশি দিন থাকতে পারতেন না মিতুলরা। পরে জেলা প্রশাসক ও সমাজকল্যাণ অধিদফতরে গেলে তারা মুজিববর্ষ উপলক্ষে ঘর দেয়ার কথা বলে। মিতুল বলেন, ‘এখন আমরা আমাদের মতো থাকি। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কও ভালো। আশপাশের সবাই খুব আন্তরিক, আমাদের প্রতিবেশী হিসেবেই দেখেন সবাই।’

থার্ড জেন্ডার ভেপেলপমেন্ট অরগানাইজেশ নামে একটি সংগঠন রয়েছে জানিয়ে মিতুল বলেন, ‘এখানে আমরা সবাই মিলে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালি। এ ছাড়া কেউ পার্লারে কাজ করে, কেউ নাচ-গান করে, কেউ সেলাইয়ের কাজ করে। আমরা এখানে এক পাতিলে রান্না করে খাই। সবজিও তো লাগে, তাই এখানেই শাক-সবজি লাগিয়ে নিয়েছি। গরু-ছাগল-মুরগি এগুলো আমাদের যৌথ সম্পদ, যেহেতু আমরা সবাই এক পাতিলে রান্না করে খাই।’

এক প্রশ্নের উত্তরে মিতুল বলেন, ‘আমাদের সবাই লেখাপড়া জানে না। সবার একটু লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা গেলে আমরা খুবই উপকৃত হব। আমরা চাই আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে হোক কিংবা অন্য যেভাবেই হোক, আমরা একটু বাংলা ও আরবি পড়ালেখা করব।’

আশ্রয়ণ প্রকল্পে কথা হয় কাশিনাথপুরের তৃতীয় লিঙ্গের রবিনের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগে বাসাবাড়িতে থাকতাম। ৫টা মানুষ আসলে বলত ওদের বাসায় হ্যান আসে, ত্যান আসে। তারপর ভাড়াটিয়ারা অনেক বকাবাদ্য করত, গাল দিত। এখন এইখানে বাড়ি করে দিছে সরকার, এখানে খুব সুখেই আছি। জোর গলায় কথা বলতে পারতেছি। খোলামেলা জায়গায় বেড়াতে পারতেছি, জিনিষপত্র পুষতে পারতেছি।’

একই রকম কথা বলেন তৃতীয় লিঙ্গের সৃজনীও। তার ভাষ্য, ‘এখানে আমাদের অনেক সুবিধা। আমরা চিল্লাপাল্লা করলে কেউ কিছু বলে না। নাচ-গান করলে কেউ কিছু বলে না। কিন্তু আগে যখন ভাড়া বাসায় থাকতাম, একটু শব্দ হলেই ফ্ল্যাটের লোকজন বলত- নেমে যাও, এখানে তোমাদের রাখা যাবে না। ওপরের ফ্ল্যাটের লোকজন বলত, ওদের রাখলে আমরা থাকব না। তখন বাড়িওয়ালাও বলত, তোমরা চলে যাও। বলত, আপনার বাড়ি করে চলে যান।’

জাগা গেছে, হেমায়েতপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ৬৫ জন গৃহহীনকে ঘর ও জমি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি ঘর পেয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা। বাকি ঘরগুলো পেয়েছেন রোহেনা ও মরজিনাদের মতো অসহায়-অস্বচ্ছল গৃহহীন ব্যক্তিরা।

এই প্রকল্পে ঘর পেয়েছে হেমায়েতপুরের গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব রোহেনা। তিনি বলেন, ‘আগে ঘর ছিল না। এখন ঘর পেয়ে আশ্রয় পেয়েছি।’

সত্তরে পা ফেলা মরজিনার স্বামী মারা গেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। মরজিনা বলেন, ‘আমার স্বামী পাকশী পেপার মিলে চাকরি করত যুদ্ধের সময়। ঘর থেকে বের হয়েছিল, আর ফিরে আসেনি। মেয়ে তখন গর্ভে। প্রসবের পর মেয়েকে নিয়েই ছিল সব চিন্তা। সদর হাসপাতালে আয়ার চাকরি করে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ছোট একটা ঘর ছিল, সেটা মেয়ের স্বামীর এক চিকিৎসা খরচ দিতে গিয়ে বিক্রি করেছি। মেয়ে এখন স্বামীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকে। ওর স্বামী পাবনা সদরের হাসপাতালের কাছেই রাস্তার পাশে চা বিক্রি করে।’

কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ৭০ বছর বয়সী মরজিনা। কান্না সামলে উঠে বলেন, ‘সরকার আমাকে বাড়ি করে দেয়ায় অনেক শান্তি লাগছে। শেষ বয়সে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলাম। আমার পায়ের নিচে মাটি ছিল না, এখন খুব সুন্দর জমি পেয়েছি। মেয়ের স্বামীর বাসায় তো বেশি দিন থাকা যায় না। এখন মেয়ে আমার এখানে বেড়াতে আসে।’

চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে মরজিনা মাসে ১৫০০ টাকা করে পান পাবনা সদর হাসপাতাল থেকে। সেই টাকা দিয়ে নিজের খরচ চালান। ঘরের পাশের জমিতে সবজি লাগিয়েছেন। সে সবজি রান্না করেন। তিনি বলেন, ‘এখন সময় ভালোই কাটছে। অন্তত থাকার ঘর আছে তো!’

ভূমিহীন সাহেব আলী ভিক্ষা করে সংসার চালান। তার স্ত্রী মাজেদা সারাবাংলাকে বলেন, ‘মানুষের কাছে চেয়ে খাই আমরা। আগে হেমায়েতপুরে ৮০০ টাকা দিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতাম। সরকার ঘর দেওয়ায় এখন থাকার আশ্রয় হলো। এখন আর ভাড়া দিতে হয় না। এটা আমাদের জন্য বিরাট বড় এক উপকার।’

এই আশ্রয়ণ প্রকল্পেই কথা হয় মো. ঝন্টু পরামণিকের সঙ্গে। ২০০১ সালে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে তিনি ঘর পেয়েছিলেন। এখানে ঘর পাওয়া ব্যক্তিদের জন্যে গড়ে তোলা বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক তিনি।

ঝন্টু সারাবাংলাকে বলেন, হেমায়েতপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৩৫৫ ঘর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর গৃহহীনদের ঘর করে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। ২০০১ সালের প্রথম দিকে এখানে ২০০ ঘর করে দেন তিনি। ২০০৭ সালে এখানে ৫০ ঘর, ১০ সালে ৫০ ঘর, মুজিববর্ষে ৬৫ ঘর করা হয়। কিন্তু ২০০১ সালের ঘরগুলো একেবারে অকেজো হয়ে গেছে। একটি ঘরেও এখন আর থাকার অবস্থা নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রত্যাশা, তিনি এই ঘরগুলো আবারও করে দেবেন। আর এখান রস্তাঘাটের অবস্থা ভালো না। আমাদের যাতায়ত করতে খুব কষ্ট হয়। এ বিষয়ে সরকারের সুনজর দরকার।

স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নোয়াখালী সফরে গিয়ে আশ্রয়হীনদের প্রথম পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম সরকার গঠনের পর ১৯৯৭ সালে আশ্রয়হীনদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি অর্থায়নে প্রথম উদ্যোগ হিসেবে গ্রহণ করেন ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’। পরে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে দেশকে গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত করার ঘোষণা দেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণার পর আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত চার দফায় দুই লাখ ৩৮ হাজার ৮৫১টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। বুধবার পঞ্চম ধাপে আরও ২২ হাজার ১০১টি গৃহহীন-ভূমিহীন পরিবারকে ঘরসহ বাড়ি হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে খুলনার তেরখাদার বারাসাত সোনার বাংলা পল্লী আশ্রয়ণ প্রকল্প, পাবনার বেড়া উপজেলার চাকলা আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আমানউল্যাহপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে ঘরগুলো হস্তান্তর করবেন।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

আশ্রয়ণ আশ্রয়ণ প্রকল্প-২

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর