Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সংবিধানিকভাবে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি চান পাহাড়িরা

প্রান্ত রনি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৯ আগস্ট ২০২৩ ১০:৪৮

রাঙ্গামাটি: আজ (৯ আগস্ট) আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত হচ্ছে আজ। দেশের সমতলের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়াসহ অন্যান্য ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ দিবসটি পালন করে আসছেন। এবারও পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিতে দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে আদিবাসী ফোরাম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল শাখার আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-২০২৩ উদযাপন কমিটি।

সংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠী ব্যতিত অন্য জাতিগোষ্ঠীকে সংবিধানে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠী উল্লেখ করা হলেও ‘আদিবাসী’ হিসেবে বলা হয়নি। তবে সংবিধানিকভাবে নিজেদের ‘আদিবাসী’ পরিচয়ে স্বীকৃতি চান পাহাড়ের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়াসহ অন্যান্য জাতির মানুষ। ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি চান সমতল জেলায় বসবাসরত গারো, সাওতাল, মনিপুরীসহ অন্যান্য জাতির মানুষেরাও। যাদের প্রত্যেক জনগোষ্ঠীরই নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। তবে বর্তমানে আধুনিকতার ভিড়ে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে হারাতে বসেছে অনেক জাতিগোষ্ঠীই। বিশেষত বিবাহ সংস্কৃতি, বিভিন্ন প্রাচীন খেলাধুলাসহ বিভিন্ন রীতিনীতিও বিলুপ্তপ্রায়। তবে এসব সংরক্ষণের জন্য নিজেদের চর্চা বাড়াতে হবে মনে করেন এসব জাতিসত্তার মানুষ। একইসঙ্গে তারা সংবিধানে সম্মানজনক হিসেবে নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলায় পাহাড়িদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে সাংস্কৃতিক সংগঠন জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল (জাক)। সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সংস্কৃতিকর্মী পূর্ণা চাকমা মনে করেন, ‘ইতিহাস ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখেই জুম পাহাড়ের নান্দনিক সংস্কৃতিগুলো যুগ-যুগান্তরের স্রোতধারায় স-গৌরবে দীপ্তিমান হয়ে রয়েছে। তবে সংস্কৃতি সংরক্ষণে নিজেদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রকেও তাদেরকে সাংবিধানভাবে সম্মানসূচক আদিবাসী স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।’

উন্নয়নকর্মী সুপ্তি দেওয়ান বলেন, ‘যে জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভাষা ও লিপি আছে এবং নিজ ভূখণ্ডে আদিকাল থেকে তা সগৌরবে লালন-পালন করে আসছে তাদেরকে আদিবাসী বলা হয়। এই সংজ্ঞা অনুসারে পাহাড়ের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ অন্যান্য ভাষাভাষির আদিবাসী মানুষ রয়েছে। আদিবাসী দিবসে বিশ্বের সকল আদিবাসীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।’

অধিকারকর্মী নুকু চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোনো একটি দেশে বা অঞ্চলে মূল স্রোতধারার জাতি বা গোষ্ঠী থেকে ভিন্ন ও অনগ্রসর জাতি যারা ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলে ঐতিহ্যগতভাবে বংশ পরম্পরায় নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে জীবনাচরণ করে তারাই আদিবাসী। আমরা চাই বিশ্বের সকল আদিবাসীর মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।’

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক ইন্টুমনি তালুকদার বলেন, ‘১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৪৯/২১৪ ধারা অনুযায়ী প্রতি বছরের ৯ আগস্টকে আদিবাসী দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। সারা বিশ্বের আদিবাসী মানুষের মতো বাংলাদেশে আমরাও আদিবাসী দিবসটি পালন করে আসছি। তবে বর্তমানে অন্যান্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশের ৪০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগণ এখন এক কঠিন সংকট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভূমি থেকে ক্রমান্বয়ে তারা উচ্ছেদের মুখোমুখি হচ্ছে। ভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের চিরায়ত অধিকার থেকে আদিবাসীরা বঞ্চিত হচ্ছে। আদিবাসীদের আত্ম-পরিচয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারই হলো মানবাধিকার।’

এদিকে, এবার ৯ আগস্ট, আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন উপলক্ষে ১২ দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। সংগঠনটির উত্থাপিত দাবিসমূহ হলো- আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারসহ ‘আদিবাসীদের’ সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। জনগোষ্ঠীসমূহের তরুণ সমাজের নেতৃত্ব বিকাশ, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বিশেষ পদক্ষে গ্রহণ করতে হবে।

‘আদিবাসী’ ইস্যুতে অন্যান্য দেশের মতো সরকার, জাতিসংঘ ও ‘আদিবাসী’ জনগণ- এই ত্রিপক্ষীয় সংলাপের জন্য উৎসাহ ও প্রণোদনা দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে ও এ উপলক্ষে রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। সমতল অঞ্চলের ‘আদিবাসীদের’ জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে। এসব জনগোষ্ঠীর ভূমিতে তাদের স্বাধীন সম্মতি ছাড়া ইকোপার্ক, সামাজিক বনায়ন, ট্যুরিজম ও ইপিজেড বা অন্য প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না। এসব জনগোষ্ঠীর ওপর সকল নিপীড়ন, নির্যাতন ও হয়রানি বন্ধ করাসহ সকল মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহীত আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র ও আইএলও ১৬৯ নম্বর কনভেনশন অনুসমর্থন ও আইএলও কনভেনশন ১০৭ বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতীয় সংসদে ‘আদিবাসীদের’ জন্য বিশেষ কোটা সংরক্ষণ করতে হবে এবং আসন বরাদ্দ দিতে হবে। সরকারি প্রথম শ্রেণিতে পূর্বের মতো ‘আদিবাসী কোটা’ সংরক্ষণ হবে এবং অন্যান্য চাকুরিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি কোটা যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। ১২ দফা দাবির সর্বশেষ দাবি হলো রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত সভা-সমাবেশ, সেমিনারে পাহাড়ে বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ সমতলের গারো, সাওতাল, মনিপুরীসহ অন্যান্য ভাষাভাষী জাতিসমূহকে সাংবিধানিকভাবে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি দাবি জানিয়ে আসছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সহযোগী ছাত্র সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদও (পিসিপি)। তবে আদিবাসী দিবস প্রসঙ্গে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানতে চাইলে সংগঠনটির শীর্ষনেতা এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আদিবাসী নিয়ে অনেকেই অনেকভাবে মনগড়া ব্যাখ্যা বক্তব্য দিতে থাকেন। কেউ কেউ এও বলে থাকেন আদিকাল থেকে বসবাস করলে নাকি তাকেও আদিবাসী বলা হয়। কিন্তু এগুলো সঠিক সংজ্ঞা নয়। জাতিসংঘের আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী আদিবাসী স্বীকৃতি সকল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দাবি। আমরা সরকারকে অনুরোধ করব সকল ধরণের ইগো বাদ দিয়ে দ্রুত আদিবাসী স্বীকৃতি দিয়ে পাহাড় ও সমতলের সকল আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করুন।’

রাঙ্গামাটিতে কর্মসূচি

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-২০২৩ উপলক্ষে রাঙ্গামাটিতে র‌্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে দিবস উদযাপন কমিটি। উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ইন্টুমনি তালুকদার জানিয়েছেন, এবারের আদিবাসী দিবসের স্লোগান হলো- ‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আদিবাসী তরুণরাই মূল শক্তি’। দিবসটি পালন উপলক্ষে বুধবার (৯ আগস্ট) সকাল সাড়ে ৯টায় রাঙ্গামাটি পৌরসভা চত্বরে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন রাঙ্গামাটি আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার। আলোচনা সভার পর সকাল সাড়ে ১১টায় পৌরসভা চত্বর একটি বর্ণাঢ্য র‌্যালি শুরু হয়ে জেলা শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে জেলা শিল্পকলা একাডেমি এলাকায় গিয়ে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

অন্যদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়িরা নিজেদের ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসলেও এই দাবির বিরোধিতা করে আসছে স্থানীয় বাঙালিভিত্তিক সংগঠনগুলো। মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) রাঙ্গামাটি শহরের বনরূপায় আদিবাসী দিবসের বিরোধিতা করে মানববন্ধন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ নামের একটি ছাত্র সংগঠন। তারা মানববন্ধনে ‘আদিবাসী স্বীকৃতি দাবির অন্তরালে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ তুলেছেন।

সারাবাংলা/ইআ

আদিবাসী দিবস


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

‘আমাদের সেনাবাহিনী যেন তৈরি থাকে’
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:২৯

আগস্টে কমেছে মূল্যস্ফীতি
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:০৭

সম্পর্কিত খবর