Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘আধ্যাত্মিক চিকিৎসা’র নামে ধর্ষণ-যৌন নির্যাতনের কালো জগৎ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
৯ আগস্ট ২০২৩ ১১:৩১

জিনের আছর বা দুষ্ট আত্মা ভর করার মতো বিষয়গুলোতে বিশ্বাস করেন না অনেকেই। তবে অনেকেই বিশ্বাস করেন এসব অতিপ্রাকৃত শক্তিতে। আর এসবের প্রতিকার পেতে ছুটে যান ‘আধ্যাত্মিক হুজুর’দের কাছে। আরব দেশেও এমন ‘আধ্যাত্মিক হুজুরে’র সংখ্যা কম নয়। অতিপ্রাকৃত শক্তির হাত থেকে মুক্তি তো বটেই, সন্তান জন্ম দিতে না পারা বা এ ধরনের সমস্যাতেও তাদের দ্বারস্থ হন অনেকেই, যার বড় একটি অংশই নারী।

আরব দেশ সুদান ও মরক্কোতে এমন কিছু ‘হুজুরের’ তথ্য বেরিয়ে এসেছে, যাদের কাছে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী চিকিৎসা বা পরামর্শ নিতে গিয়ে যৌন নির্যাতন থেকে শুরু করে ধর্ষণের শিকার পর্যন্ত হয়েছেন নারীরা। বিবিসির অনুসন্ধানে ‘ধর্মীয় চিকিৎসা’র নামে নারীদের নিগ্রহের শিকার বানানোর এমনই এক কালো জগৎ উন্মোচিত হয়েছে।

বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, ধর্মীয় চিকিৎসা বা আধ্যাত্মিক চিকিৎসার চর্চা আরব দেশগুলোসহ মুসলিম বিশ্বে সাধারণ এবং এটি ‘কুরআনের চিকিৎসা’ নামেও পরিচিত। সিংহ ভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের চিকিৎসার গ্রাহক নারীরা। তারা বিশ্বাস করেন ‘আধ্যাত্মিক হুজুর’রা খারাপ জিন বা দুষ্টু আত্মাদের তাড়িয়ে তাদের সমস্যা ও রোগের চিকিৎসা করতে পারেন।

বিবিসি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মরক্কো ও সুদানের ৮৫ জন নারীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে। তাদের দেয়া তথ্য বলছে, দুই দেশেই এরকম ধর্মীয় চিকিৎসা ও হুজুররা যথেষ্ট জনপ্রিয়। তবে এই অনুসন্ধানে দেশ দুটির ৬৫ জন তথাকথিত হুজুরের নাম উঠে এসেছে, যাদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতন এবং এমনকি ধর্ষণের অভিযোগ পর্যন্ত রয়েছে।

এদিকে লোকলজ্জার ভয়ে এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ট্যাবুর কারণে এসব অভিযোগ চেপে যান নারীরা। তারা মনে করেন, কথিত হুজুরদের যে প্রভাব, তাতে তাদের অভিযোগ কেউ বিশ্বাসই করবেন না। দেশ দুটির সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বলছে, এসব হুজুরের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের বিষয়টি তারা জানেই না।

বিবিসি আরবের অনুসন্ধানী প্রতিবেদকরা কয়েক মাস ধরে এনজিও, আদালত, আইনজীবী ও নারীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং সেগুলো যাচাই করেছেন। শুধু তাই নয়, বিবিসির একজন নারী প্রতিবেদক অনুসন্ধানের স্বার্থে রোগী সেজে কথিত এক হুজুরের কাছে গিয়েছিলেন। ওই কথিত হুজুর তাকেও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেন।

দালাল ছদ্মনামের এক তরুণী কয়েক বছর আগে মরক্কোর ক্যাসাব্লাংকা শহরের পাশের একটি শহরে এমনই এক কথিত ‘হুজুরের’ কাছে গিয়েছিলেন বিষণ্ণতার সমস্যা নিয়ে। ওই সময় তার বয়স ছিল ২০ বছর। ওই ‘হুজুর’ তাকে বলেন যে তার এই বিষণ্ণতার জন্য দায়ী একটি ‘প্রেমিক জিন’, যে কি না দালালের ওপর ভর করে আছে।

কথিত সেই ‘হুজুরের’ কাছে চিকিৎসা নেওয়ার একপর্যায়ে একা সাক্ষাৎ করতে হয়েছিল দালালকে। সেবার তাকে চিকিৎসার কথা বলে কস্তূরীর ঘ্রাণ নিতে বলেন ওই ‘হুজুর’। দালাল বলেন, পরে তিনি বুঝতে পারেন যে সেটি কস্তূরী ছিল না, সেটি ছিল মূলত এক ধরনের চেতনানাশক মাদক। কারণ ওই বস্তুর ঘ্রাণ নেওয়ার পরই তিনি অচেতন হয়ে পড়েন।

এর আগে যৌন সম্পর্কের অভিজ্ঞতা ছিল না দালালের। তিনি জানান, ‘হুজুরের’ কাছে ওই সেশনের পর জ্ঞান ফিরলে তিনি দেখেন তার অন্তর্বাস খোলা। দালাল বুঝতে পারেন, তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দালাল বলেন, তিনি ওই হুজুরকে চিৎকার করে বলতে থাকেন, কেন তার সঙ্গে এমন করা হয়েছে। জবাবে ওই হুজুর তাকে বলেন, দালালের শরীর থেকে জিনকে বের কর দেয়ার জন্য তাকে এমন (ধর্ষণ) করতে হয়েছে।

দালাল বিবিসি আরবকে বলেন, লোকলজ্জার কারণেই এ ঘটনা তিনি কাউকে জানাননি। তাছাড়া তিনি জানতেন, ঘটনাটি জানলে সবাই তাকেই দোষারোপ করবে। ওই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পর দালাল অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। আতঙ্কে আত্মহত্যার কথা পর্যন্ত ভেবেছিলেন তিনি।

বিবিসি আরবের প্রতিবেদকরা বলেন, তারা যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তাদের অনেকেরই মন্তব্য ছিল দালালের মতোই। তারা বলছিলেন, তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো প্রকাশ পেলে সবাই তাদেরই দোষারোপ করবে। অনেকে আবার বলেছেন, ঘটনাগুলো প্রকাশ পেলে দুষ্টু জিনরা প্রতিশোধ নেবে বলেও তারা বিশ্বাস করেন।

সুদানে সাওসান নামে এক নারী বিবিসি আরবের প্রতিবেদক দলকে বলেন, তার স্বামী তাকে নিঃস্ব অবস্থায় ফেলে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে যান। ওই সময় তিনি সাহায্যের জন্য এক কথিত হুজুরের কাছে যান। কিন্তু হুজুর তাকে তার সমস্যা সমাধানের জন্য যে পথ বাতলে দেন, তা তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।

 সুদানের সাওসান বলেছেন, হুজুর পরামর্শ দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক তাকে তার স্বামীর সঙ্গে পুনর্মিলনে সহায়তা করবে

সাওসান বলেন, ‘তিনি (কথিত হুজুর) আমাকে বলেন, তিনি আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করবেন। এতে আমার শরীর থেকে যে তরল বের হবে, তা দিয়ে তিনি একটি ওষুধ তৈরি করবেন, যা আমার স্বামীকে খাওয়াতে হবে।’

এ ঘটনার কথা সাওসান কাউকে বলেননি। তিনি বলেন, ‘তিনি আমাকে এ কথা যেভাবে বলেছেন, মনে হয়েছে তার কোনো ভয়ই নেই। তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে আমি এ ঘটনার কথা পুলিশ তো দূরের কথা, আমার স্বামীকেও বলব না।’

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, সুদানে কথিত হুজুরদের নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার ৫০ জন নারীর সঙ্গে কথা বলে শেখ ইব্রাহিম নামে একজনের নাম উঠে এসেছে, যিনি নারীদের এভাবে নির্যাতন করে থাকেন। কিন্তু নির্যাতনের শিকার নারীরাই বলছেন, ইব্রাহিম শেখ যে এমন করতে পারেন, তা সাধারণ মানুষ কখনো বিশ্বাস করবে না।

শেখ ইব্রাহিম

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নারী জানান, শেখ ইব্রাহিম তাকে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করেছিলেন। আফাফ নামে আরেকজন জানান, তার সঙ্গেও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের কথা শেখ বলেছিলেন। তিনি জোর করে তাকে ঠেকিয়েছিলেন, যদিও ভীষণ অসহায় বোধ করছিলেন তিনি।

আফাফ বলেন, ‘শেখ এসব কথা বলে এবং এসব কাজ করে, তা কেউ মানবেই না। কেউ বিশ্বাস করবে না। তাদের বিশ্বাস করানোর মতো সাক্ষী আমি কোথায় পাব? আমাকে তো তার ঘরে তার সঙ্গে থাকা অবস্থায় কেউ দেখেনি!’

এ পরিস্থিতিতে শেখ ইব্রাহিমকে হাতেনাতে ধরতে বিবিসির একজন প্রতিবেদক ছদ্মবেশে তার কাছে যেতে যেতে রাজি হন। ওই প্রতিবদেককে রিম নামে ডাকা হচ্ছিল। ঠিক করা হয়, রিম বন্ধ্যত্বের সমস্যার সমাধান পেতে যাবেন শেখ ইব্রাহিমের কাছে। রিম সেখানে যাওয়ার পর শেখ ইব্রাহিম বলেন, তিনি তার জন্য দোয়া করবেন এবং এক বোতল পানি পড়ে দেবেন, যাকে বলা হয় ‘মাহায়া’। রিমকে এই পানি বাসায় নিয়ে পান করতে হবে।

রিম বলেন, এরপরই ইব্রাহিম তার কাছে ঘেঁষতে থাকেন এবং একপর্যায়ে তার পেটের ওপর হাত তুলে দেন। রিম তাকে হাত সরাতে বললে তিনি হাত সরাননি, বরং রিমের শরীরের আরও স্পর্শকাতর জায়গায় হাত নেয়ার চেষ্টা করেন। এ পর্যায়ে রিম ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। রিম বলেন, তার মনে হয়েছে যে শেখ মেয়েদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করেই অভ্যস্ত।

বিবিসির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে শেখ ইব্রাহিম মেয়েদের হেনস্তা ও যৌন নির্যাতন করার সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেন। রিমের কথা সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাইলেও তিনি উত্তর না দিয়ে আচমকা কথা বলা বন্ধ করে চলে যান।

এসব কদর্য অভিজ্ঞতার বাইরে শেখ ফাতেমা নামে একজন নারী অন্য নারীদের জন্য আধ্যাত্মিক চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। সুদানের রাজধানী খার্তুমে তার একটি চিকিৎসাকেন্দ্র আছে, যেখানে সবাই নারী। বিবিসির প্রতিবেদক দল সেখানে গেলে তাদের আলাদা করে বসার জায়গা দেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা নিতে যাওয়া নারীদের প্রত্যেককেই মানসিকভাবে অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায় দেখা যায়।

শেখ ফাতেমা বলছিলেন, নারীদের এমন অবস্থারই সুযোগ নেন কথিত হুজুররা। তিনি বলেন, অনেক নারীই আমাদের কাছে এসে বলেছেন, শেখ ইব্রাহিম তাদের শরীর থেকে দুষ্টু আত্মাকে বের করার কথা বলে তাদের শরীর স্পর্শ করেছেন। এসব নারীরা ভাবতেন, শেখ যে তাদের শরীরে অযাচিত স্পর্শ করছে, সেগুলোও চিকিৎসারই অংশ। একজন নারীর মুখ থেকে এ ধরনের কথা শোনার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ।

বিবিসির প্রতিবেদকরা কয়েকটি ঘটনার তথ্য-প্রমাণ নিয়ে মরক্কো ও সুদান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সুদানের ইসলামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিবার ও সমাজকল্যাণ বিভাগের প্রধান ড. আলা আবু জেইদ বিশ্বাসই করতে চাননি যে কথিত হুজুরদের হাতে এত নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবে এসব কথিত হুজুরদের কথিত আধ্যাত্মিক চিকিৎসা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় যে সমাজে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে, সেটি স্বীকার করেন তিনি। ড. আলা বলেন, ‘অনেকেই আছে যাদের কাজ-কর্ম নেই। তারাই এটিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে।’

এদিকে এসব কথিত হুজুরদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা আইনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না মরক্কোতে ইসলামবিষয়ক মন্ত্রী আহমেদ তৌফিক। তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে আইনিভাবে হস্তক্ষেপ করা কঠিন। ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রচারের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে।’

সারাবাংলা/আইই/টিআর

টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর