শেষ নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য ঠাঁই খুঁজছেন যে মা
১৩ মে ২০১৮ ১২:১৫
।। রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব অগণতি মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন তাদের একজন চট্টগ্রামের রমা চৌধুরী। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাসাহিত্যে মাস্টার্স করে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হয়েছিলেন এই নারী। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনটাকে ওলটপালট করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে নিজের জীবনযুদ্ধের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সেই সময়ের বলি হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে তার তিন ছেলেকেও। নিজের এবং জীবিত এক ছেলের মুখের ভাত জোটাতে প্রায় ৩০ বছর ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে নিজের লেখা বই বিক্রি করেছেন তিনি। কখনও কারও কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেননি। প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাশীল এই সংগ্রামী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহায্যের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রায় ৭৫ বছর বয়সী নিজের ভাষায় ‘একাত্তরের জননী’ সেই রমা চৌধুরী এখন মৃত্যুশয্যায়। শরীরে নানা রোগব্যাধি নিয়ে শুয়ে আছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি ছোট্ট কেবিনে। চিকিৎসকরা বলেছেন, যে কোন মুহুর্তেই নিভে যেতে পারে রমা চৌধুরীর জীবনপ্রদীপ। মৃত্যুর আগে তিনি চান হাসপাতাল ছাড়তে। কিন্তু কোথায় যাবেন ? এই শহরে একটি বাসা ভাড়া করে থাকার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই এই নারীর। জীবনসায়াহ্নে এসে প্রায় ৬৫ বর্গমাইলের এই শহরে মুক্ত বাতাসে শেষ নিঃশ্বাসটি নেওয়ার জন্য একটি ঠাঁই খুঁজছেন এই অসহায় মা।
দুই বছর আগেও তপ্ত রোদের মধ্যে খালি পায়ে পিচঢালা পথে হেঁটে শহর ঘুরে বই বিক্রি করে বেড়ানো এই বীরাঙ্গনা এখন মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। কেউ দেখতে গেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। দুই চোখ দিয়ে গড়ায় অশ্রু। বারবার হাত ধরে বলতে থাকেন, ‘আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল। আমাকে বাড়ি নিয়ে চল।’
রমা চৌধুরীর বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে। সেই গ্রামে তাদের একটি ঘর আছে। তবে মৃত্যুপথযাত্রী একজন অসুস্থ রোগীকে সেই ঘরে রাখা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন তার দেখভাল করা আলাউদ্দিন খোকন, যিনি রমা চৌধুরীর সব বইয়ের প্রকাশকও। এছাড়া একাত্তরে সম্ভ্রম হারানোর পর নিয়মিত লাঞ্ছনা-গঞ্জনায় যে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল রমা চৌধুরীকে, মৃত্যুর আগমুহুর্তে সেই গ্রাম আর টানছে না তাকে।
আলাউদ্দিন খোকন সারাবাংলাকে বলেন, ‘জোর করে একবার গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে যাবার পরই দিদির (রমা চৌধুরী) রক্তবমি শুরু হয়। এরপর তাকে আবারও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসি। তখন ডাক্তার বলেছেন, যে কোন মুহুর্তে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সুতরাং উনাকে যেন শহরের বাইরে নিয়ে না যাই।’
রমা চৌধুরীর ছেলে জহরলাল চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার মা ছয়দিনও বাঁচতে পারেন, ছয়মাসও বাঁচতে পারেন। জীবনের শেষ সময়টুকু আমার মা নিজের মতো করে থাকতে চেয়েছেন। এই দেশের জন্য আমার মায়ের ত্যাগ আছে। আমরা মা কখনও মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট চাননি। ভাতা চাননি। সাহায্য চাননি। কোনমতে খেয়েপরে আমরা বেঁচে আছি। আমার মা যেন তার প্রাপ্য সম্মানটুকু নিয়ে মরতে পারেন, আমি দেশের মানুষের কাছে সেটাই প্রত্যাশা করছি।’
খোকন জানালেন, তারা বাসা ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রথমত শুধুমাত্রা একজন অসুস্থ রোগীর জন্য বাসা ভাড়া দিতে আগ্রহী নন অনেক বাড়িওয়ালা। অনেকে আবার রমা চৌধুরীকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, একাত্তরের ইতিহাস জানেন। তারাও বাসা ভাড়া দিতে আগ্রহী নন। এছাড়া বাসা ভাড়ার জন্য অগ্রিম হিসেবে এক লাখ- দুই লাখ টাকা দেওয়ার মতো সঙ্গতিও তাদের নেই।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একাত্তরের ১৩ মে তিন শিশু সন্তান নিয়ে পোপাদিয়ায় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন রমা চৌধুরী, স্বামী ছিলেন ভারতে। ওইদিন এলাকার পাকিস্তানিদের দালালদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনীর লোকজন তাদের ঘরে হানা দেয়। নিজের মা আর পাঁচ বছর ৯ মাস বয়সী ছেলে সাগর ও তিন বছর বয়সী টগরের সামনেই তাকে ধর্ষণ করে এক পাকিস্তানি সৈনিক।
নিজের লেখা একাত্তরের জননী গ্রন্থের ৫২ পৃষ্ঠায় নিজের ধর্ষিত হওয়ার কাহিনীর পাশাপাশি রমা চৌধুরী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পৈশাচিকতার বর্ণনা দিয়ে লিখেন, ‘সেদিন আমাদের পাড়ায় কত মেয়েকে যে ধর্ষণ করেছে পিশাচগুলো তার কোন ইয়ত্তা নেই। যুবতী মেয়ে ও বৌ কাউকেই ছাড়েনি। গর্ভবতী বৌ এমনকি আসন্ন-প্রসবারাও বাদ যায়নি। এসব কথা জানতে পেরে আমি অন্তরের গ্লানি ভুলে নিজেকে কোনমতে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও মা কিন্তু আমার গর্ভে হানাদারের সন্তান আসতে পারে ভেবে আতংকে ও উদ্বেগে ছটফট করতে থাকেন।`
পাকিস্তানিদের কাছে নির্যাতিত হয়ে সমাজের লাঞ্চনায় এবং ঘরবাড়ি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়লেন রমা চৌধুরী। দিনান্তে ভাত জুটছে না। অনাহারে, অর্ধহারে অসুস্থ হয়ে ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর মারা যায় বড় ছেলে সাগর। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মারা যায় দ্বিতীয় সন্তান টগর। ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তৃতীয় সন্তান টুনু।
তিন সন্তান মাটির নিচে, জুতা পরে মাটির উপরে হাঁটলে তারা ব্যথা পাবে-এমন এক আবেগ থেকে জুতা পরেন না রমা চৌধুরী।
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নিজের লেখা বই ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন রমা চৌধুরী। ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত নিজের নিয়মে বই বিক্রি করে গেছেন তিনি।
আলাউদ্দিন খোকন সারাবাংলাকে জানান, এরপর আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন রমা চৌধুরী। হাঁটতে পারেন না। প্রায় ঘরবন্দি হয়ে যান। ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর নগরীর চেরাগি পাহাড়ের লুসাই ভবনে যে ছোট্ট ঘরটিতে থাকতেন তিনি, সেখানে পড়ে গিয়ে কোমড়ে মারাত্মক চোট পান। এরপর থেকে পুরোপুরি শয্যাশায়ী। এখন গলব্লাডারে পাথর, ডায়াবেটিস, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অসুস্থ রমা চৌধুরীকে দেখতে গিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনকে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। এরপর আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া প্রাইভেট ক্লিনিকের ভাড়া পরিশোধ করে রমা চৌধুরীকে চমেক হাসপাতালে এনে ভর্তি করান। নিয়মিত শুশ্রুষার জন্য ‘পে ইট ফরোয়ার্ড’ নামে একটি সংগঠন প্রতি মাসে একজন সেবিকার বেতন দিচ্ছে। রোগী কল্যাণ সমিতি বিনামূল্যে ওষুধ দিচ্ছে।
তিনি বলেন, এর বাইরেও একজন রোগীর জন্য অনেক খরচ আছে। দিদি তো অসুস্থ। এখন আর বই বিক্রি নেই। ইনকামের কোন পথও নেই। ডাক্তার বারবার বলছেন, হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে। কিন্তু কোথায় নিয়ে যাব ? চেরাগি পাহাড়ের ছোট কক্ষটিতে উনাকে রাখা সম্ভব নয়। নতুন বাসা নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না।
‘দিদি (রমা চৌধুরী) একজন বীরাঙ্গনা, একজন মুক্তিযোদ্ধা। এই রাষ্ট্র কি দিদির সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে না ?’
মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের এ রীতি শুধু আধুনিককালের নয়, বহুকাল আগের গ্রিক ও রোমান সভ্যতাতেও এর নিদর্শন পাওয়া যায়।মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও মমতা শুধু মা দিবসে নয়, প্রকাশিত হোক প্রতিটি দিন :)#Mothers_Day#Sarabangla_Dot_Net
Posted by Sarabangla.net on Saturday, 12 May 2018
সারাবাংলা/আরডি/একে