‘মিতু হত্যার পর মুছার জন্য ১ লাখ টাকা পাঠিয়েছিলেন বাবুল আক্তার’
৯ আগস্ট ২০২৩ ২০:০৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার অন্যতম আসামি কামরুল ইসলাম শিকদার মুছার আত্মীয় কাজী আল মামুন আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন। মুছা নিহত মিতুর স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের ‘ঘনিষ্ঠ সোর্স’ ছিলেন। সাক্ষ্যে মামুন জানিয়েছেন, মিতু হত্যার পর বাবুল আক্তারের নির্দেশে মামুনের দেওয়া দু’টি বিকাশ নম্বরে মুছার জন্য এক লাখ টাকা পাঠানো হয়।
বুধবার (৯ আগস্ট) চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে মামুন সাক্ষ্য দেন।
কাজী আল মামুন (৩৫) নড়াইলের লোহাগাড়া থানার খলিসাখালি গ্রামের বাসিন্দা। তার নাসিম টিউটোরিয়াল নামে একটি কোচিং সেন্টার আছে। পাশাপাশি ‘দৈনিক বাংলাদেশের আলো’ নামে একটি জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় প্রতিনিধি তিনি।
আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে মামুন বলেন, ‘কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা আমার সাবেক স্ত্রী আবেদা জান্নাত মিমের আপন খালু। আত্মীয়তার সুবাদে ২০১৬ সালের শুরুর দিকে মুছা স্বপরিবারে আমাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসে। তখনই মুছার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ও পরিচয়। সেই সুবাদে মাঝে মাঝে মুছা আমার ও মিমের মোবাইল নম্বরে ফোন করতেন। এরপর ২০১৬ সালের জুন মাসের শুরুর দিকে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর থেকে আমাকে ফোন দেয়। ফোন করে আঙ্কেল বলেন, তোমার নম্বর বিকাশ আছে? আমি বলি, আমার দুটি নম্বরই বিকাশ করা। পাল্টা জানতে চাই, আঙ্কেল আমার বিকাশ নম্বর কেন চাচ্ছেন। তখন তিনি বলেন, আমার এসপি স্যারের এক লোক আমাকে কিছু টাকা পাঠাবে। তখন আমি আবার বলি, আপনার টাকা আমার কাছে কেন পাঠাবে? তখন তিনি বলেন, আমি (মুছা) চিটাগাং নেই। বাইরে আছি।’
তিনি তখন আরও বলেন, ‘তুমি ক্যাশ করে রাখো। আমার কোনো লোক পরে পরিচয় দিয়ে যোগাযোগ করলে (বিকাশ নম্বর দিলে) তুমি টাকাগুলো বিকাশ করে দিও।’
মুছা ও বাবুল আক্তারের পরিচয় দিয়ে তাকে টাকা পাঠানো হয় উল্লেখ করে মুছার এই আত্মীয় বলেন, ‘পরে সম্ভবত ১০ তারিখে সন্ধ্যার দিকে আমাকে ফোন করা হয়। শেষ ডিজিট সম্ভবত ৩১। ফোন করে এক লোক বলেন, আমি মুছাকে চিনি কিনা? তখন আমি বলি, হ্যাঁ মুছা আমার আত্মীয়। তাকে আমি চিনি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি কে? তখন তিনি বলেন, আমি মুছা এবং এসপি বাবুল আক্তার স্যারের পরিচিত লোক।’
“তিনি বলেন, মুছা আপনার কাছে কিছু টাকা পাঠাতে বলেছে, আপনার বিকাশ নম্বর দেন। তখন আমি নিজের দুটো ফোন নম্বর তাকে দেই। উনি বলেন, দুইটি নম্বরে তো ২৫-২৫ করে ৫০ হাজার টাকা যাবে। আমি আপনাকে টাকা পাঠাব এক লাখের মত। আপনি আরও একটি নম্বর দেন। পরে আমার বন্ধু মোস্তাইনের দোকান আছে (বিকাশ এজেন্ট) তার নম্বরটি দেই। সেই নম্বরটি এখন মনে নেই। কিছু সময় পরে আমার দুইটি নম্বরে ২৫-২৫ করে মোট ৫০ হাজার এবং মোস্তাইনের বিকাশ এজেন্ট নম্বরে ৪৯ হাজার টাকা আসে। দোকানের নম্বরে আসা টাকাটা আমি ক্যাশ করে নিয়ে যাই। আমার দু’টি নম্বরে থাকা টাকা মোবাইলেই থাকে।”
মামুন বলেন, ‘দুইদিন পরে এক লোক মুছার রেফারেন্স দিয়ে বলে আমি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে বলছি। নাম বলেছিল, এ মুহূর্তে স্মরণ নেই। তোমার কাছে যে টাকাগুলো পাঠিয়েছিল তা পাঠিয়ে দাও। কয়টা ফোন নম্বর দিয়েছিল এখন তা মনে নেই। আমার নিজের মোবাইলে যে টাকাগুলো ছিল সেগুলো ট্রান্সফার করে দেই। আর নগদ টাকা থেকে ১৮ হাজার ৫০০ টাকা মোস্তাইনের দোকান থেকে আরেকটি ফোন নম্বরে বিকাশ করে পাঠিয়ে দেই। অবশিষ্ট ৩১ হাজারের কিছু বেশি টাকা (ওইদিন বা পরের দিন) আরেকটি নম্বর দিলে সেটিতে পাঠিয়ে দেই।’
সাক্ষ্য তিনি আরও বলেন, ‘২০২১ সালের ১০ মে আমাকে পিবিআই গ্রামের বাসা থেকে নিয়ে আসে। যশোর পিবিআই অফিসের একজন কর্মকর্তা স্নেহাশীষ ফোন দেন। তখন আমি কোচিংয়ে পড়াচ্ছিলাম। তারপর তিনি আমাকে নিয়ে আসে, তারপর বলে সন্তোষ স্যার কথা বলবে। ফোনে আমাকে সন্তোষ কুমার চাকমার সাথে কথা বলিয়ে দেন। সন্তোষ স্যার বলেন, একটা মামলার বিষয়ে তথ্য নেওয়ার আছে। আপনাকে সসম্মানে আনা হবে। যশোরের পিবিআই কর্মকর্তারা আমাকে ঘাটিয়াপাড়া (মধুমতী নদীর তীরে) পর্যন্ত এনে দেয়। সেখান থেকে ঢাকা হয়ে পিবিআইর সহায়তায় চট্টগ্রাম পিবিআইতে আসি ২০২১ সালের ১০ মে।’
‘এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমার কাছে মামলার সম্পর্কে আজ যা বলেছি তাই বলি। তখন আমার কাছে যে মোবাইল সেট ছিল একটি অপপো এ থ্রিথ্রিএফ এবং সিম্ফনি ১৭২ সেটটি (বর্তমান স্ত্রী সামিয়া খানমের) এই দুইটি মোবাইল ও সিম জব্দ করে তারা। আমি জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর করি। পরবর্তীতে ১১ মে ম্যাজিস্ট্রেট মো. সফিউদ্দিনের কক্ষে আমি জবানবন্দি দেই। এটাই আমার ম্বাক্ষর। তবে আমি বাবুল আক্তারকে চিনি না। কখনও দেখিনি।’
সাক্ষ্য দেওয়ার পর মামুনকে জেরা করেন বাবুল আক্তারের আইনজীবী কফিল উদ্দিন।
এদিকে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁশুলি মহানগর পিপি আব্দুর রশীদ সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, কাজী আল মামুনের সাক্ষ্য ও জেরার পর আদালত এ মামলার কার্যক্রম বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) পর্যন্ত মুলতবি করেছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সাতজনকে আসামি করে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে। ১০ অক্টোবর আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। চলতি বছরের ১৩ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। ৯ এপ্রিল থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষী হিসেবে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনের সাক্ষ্য দেন।
অভিযোগপত্রে প্রধান আসামি করা হয়েছে মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারকে। অভিযোগপত্রে আরও যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলো— মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুছা, এহতেশামুল হক প্রকাশ, হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু এবং শাহজাহান মিয়া।
আসামিদের মধ্যে শুধু মুসা পলাতক আছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে।
সারাবাংলা/আইসি/এমও