‘এদ্দুর বয়সত এতাক্কান পানি আঁই আর ন দেহি’
৯ আগস্ট ২০২৩ ২১:২০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: কারও ঘরের ভেতর কোমরসমান, কারও ঘরে বুকসমান পানি থইথই করছে। পানিতে ভাসছে চেয়ার-টেবিল, ঘরের আসবাবপত্র। যাদের পাকা দালান, তারা আশ্রয় নিয়েছে দোতলায়। আর কাঁচা কিংবা সেমিপাকা ঘরের বাসিন্দারা কেউ ছুটছেন আশ্রয়কেন্দ্রে কিংবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। আবার কেউ পানির সঙ্গে লড়ছেন। যেসব এলাকা এখনও ডোবেনি, তারাও আশঙ্কায় ছুটছেন নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্তত তিনটি উপজেলা সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশে এমন দৃশ্য ঘরে-ঘরে। ভোগান্তিতে লাখো মানুষ। সবাই একবাক্যে বলছেন, স্মরণকালে এমন বন্যা তারা আর দেখেননি।
বুধবার (৯ আগস্ট) সকাল থেকে সারাবাংলার স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট শ্যামল নন্দী চন্দনাইশ ও সাতকানিয়ার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখেন, চন্দনাইশের হাশিমপুর বড়পাড়া থেকে কসাইপাড়া হয়ে সাতকানিয়ার কেরাণীহাট পর্যন্ত অংশ দুপুরেও পানিতে তলিয়ে আছে। মহাসড়কে পানির স্রোত আছে। এরপরও লোকজন পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছেন। অনেকে ভ্যানগাড়িতে করে ঘরের আসবাবপত্র, হাঁস-মুরগি, ছাগল নিয়ে যাচ্ছেন আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে।
চন্দনাইশের হাশিমপুর এলাকার বাসিন্দা ৬০ বছর বয়সী নুরজাহান বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বুড়া অয় গেলামগুই, এদ্দুর বয়সত এল্যা ঘটনা আঁই আর ন দেহি, এতাক্কান পানি ওবুক। (বুড়ো হয়ে গেছি, এত পানি আমার বয়সে আমি দেখিনি।)’
সাতকানিয়ার চরতী এলাকার বৃদ্ধ কৃষক মো. ইসমাইল বলেন, ’৯৭ সালে একবার ডুবছিল, ২০১৯ সালে একবার। কিন্তু এবারের মতো এত পানি তখন হয়নি।’
হাশিমপুরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাইফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের পাশাপাশি তিন গ্রামে পাঁচ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। বিদ্যুৎ নাই পাঁচদিন ধরে। টিউবওয়েল ডুবে গেছে, পানি খেতে পারছি না। অবস্থা খুব শোচনীয়।’
হাশিমপুরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মো. ফারুক তার বৃদ্ধ বাবাকে কোলে নিয়ে যাচ্ছিলেন আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের গরু-ছাগল সব চলে গেছে। কোথায় গেছে জানি না। আমার বয়স ৪০ বছর। এমন ঘটনা আমি আর দেখিনি। এত ক্ষতি হয়েছে, ভাষায় বলা যাবে না। আমার আব্বা বুড়া মানুষ, ভাত-পানি নাই দু’দিন ধরে। এজন্য আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছি।’
গত বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) সন্ধ্যা থেকে চট্টগ্রামসহ আশপাশের এলাকায় বৃষ্টিপাত শুরু হয়। দুইদিনের মাথায় সেটা অতি ভারি বর্ষণে রূপ নেয়। সোমবার সন্ধ্যার পর বৃষ্টিপাত বন্ধ হলেও মঙ্গলবার সকাল থেকে ফের থেমে থেমে চলছে, যা বুধবারও অব্যাহত আছে, তবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে।
রোববার থেকে টানা বৃষ্টির সঙ্গে অস্বাভাবিক উচ্চতার জোয়ার ও পাহাড়ি ঢল যুক্ত হয়ে বিভিন্ন উপজেলা পানিবন্দি হয়ে পড়ে। দুই দিনের ব্যবধানে সেটা বন্যা পরিস্থিতিতে রূপ নেয়। সাতকানিয়া ও চন্দনাইশে মহাসড়কে পানি উঠে যাওয়ায় কক্সবাজার ও বান্দরবানের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ কার্যত গত দু’দিন ধরে বিচ্ছিন্ন আছে।
স্থানীয়রা বলছেন, পাহাড়ি এলাকা থেকে অতি বৃষ্টির পানি সমতলের দিকে দ্রুতবেগে নেমে আসায় চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সাড়ে ৮ লাখ মানুষ বন্যা আক্রান্ত
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগের হিসেবে চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলা ও নগরী মিলে ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৫০৫ জন বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সাতকানিয়ায় সাড়ে ২২ হাজার পরিবার, চন্দনাইশে ৫ হাজার, পটিয়ায় ১৬ হাজার ৫৯৫ পরিবার এবং লোহাগাড়ায় ৪ হাজার পরিবার এখনও পানিবন্দি আছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ছাইফুল্লাহ মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, লোহাগাড়া এবং বাঁশখালী উপজেলার একাংশ এখনও পানিবন্দি অবস্থায় আছে। চার উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এরপর পটিয়ায়ও কিছু ক্ষতি হয়েছে।’
অতি ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় এ পর্যন্ত ছয়জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছেন ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ। এর মধ্যে সাতকানিয়ায় ১ জন, লোহাগাড়ায় ২ জন, বাঁশখালীতে ১ জন, রাউজানে ১ জন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার গভীর রাতে বাঁশখালীর বৈলগাঁও ২ নম্বর ওয়ার্ডে ঘরের দেয়াল ধসে মারা যায় মেজবাহ নামে পাঁচ বছর বয়সী এক শিশু।
সোমবার সন্ধ্যায় রাউজানের উরকিরচরে হালদা নদীর শাখা খালে পড়ে শাহেদ ইসলাম বাবু (৪০) নামে এক খামারির নিখোঁজের দুইদিন পর তার লাশ মিলেছে। একইদিন সকালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতাধীন হাটহাজারী উপজেলার ইসলামীয়া হাট বাদামতল এলাকায় পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পথে পানিতে পড়ে মৃত্যু হয় নিপা পালিত নামে এক ছাত্রীর। তিনি হাটহাজারী সরকারি কলেজের বিবিএস দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন।
লোহাগাড়ায় সোমবার রাতে পানির স্রোতে তলিয়ে নিখোঁজের পর মঙ্গলবার দুপুরে জুনায়েদ ইসলাম জারিফ (২২) নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের লাশ ভেসে ওঠে। জুনায়েদ বেসরকারি বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। এছাড়া সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় আরও দু’জনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে, সাতকানিয়া উপজেলার চরতীতে নৌকা উল্টে নারী ও শিশুসহ চারজন এবং মির্জাখীলে বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া মোহাম্মদ তানভীর উদ্দিন (২০) নামে এক তরুণ এখনও নিখোঁজ আছেন।
‘১০ শতাংশ পরিবারও ত্রাণ পায়নি’
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. ছাইফুল্লাহ মজুমদার জানিয়েছেন, বন্যার্তদের জন্য ৫৬৫ মেট্রিকটন চাল, নগদ ১৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ৩৫০০ প্যাকেট বিস্কুট ও ৩৫০০ প্যাকেট ওরস্যালাইন এবং সাড়ে ছয় হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাকিব হাসান সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলায় স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলায় বন্যার্তদের সহায়তায় সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরাও কাজ করছেন।
ত্রাণ পেয়েছে কি না জানতে চাইলে হাশিমপুরের বাসিন্দা রূপন কান্তি দাশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এলাকায় ৫-৬ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দি। ঘর, খেত, পুকুর, মাছের খামার সব ডুবেছে। সবাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। টেন পার্সেন্ট মানুষও ত্রাণ পেয়েছে কি না সন্দেহ আছে। অনেক এলাকায় এত পানি উঠেছে, সেখানে পৌঁছানো অসম্ভব। যারা বেশি গরীব, চেয়ারম্যান-মেম্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা কিছু ত্রাণ নিচ্ছে।’
৩১ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত
চট্টগ্রাম জেলায় আবাদযোগ্য মোট ফসলি জমির পরিমাণ ৯৬ হাজার ১৯৮ হেক্টর। এর মধ্যে ৩০ হাজার ৮১০ হেক্টর জমি চলমান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।
সংস্থার চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সৌরভ দাশ সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলা ও নগরী মিলে ৬ হাজার ৫৬৭ হেক্টর আউশ আবাদ, ৩ হাজার ৮৪৬ হেক্টর আমান বীজতলা, ১৫ হাজার ৩৩০ হেক্টর আমন আবাদ এবং ৫ হাজার ৬৭ হেক্টর শরৎকালীন সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলা মিলিয়ে মোট ৫০ হাজার ৮১৮ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সৌরভ জানান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ড. অরবিন্দ কুমার রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা আমরা প্রাথমিক হিসেব দিয়েছি। পানি নেমে যাবার পর চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির তালিকা করা হবে। এরপর ক্ষয়ক্ষতি টাকার হিসেবে চূড়ান্তভাবে নিরূপণ করা হবে।’
রেকর্ড বৃষ্টিপাত
চট্টগ্রাম জেলায় গত ছয় দিনে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। এখন বৃষ্টিপাত কিছুটা কমলেও আগামী সপ্তাহে ফের ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। বুধবার (৯ আগস্ট) বিকেল ৩টা পর্যন্ত গত সাতদিনে ৬৯৪ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস।
বুধবার বিকেল তিনটা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস ২৭ মিলিমিটার এবং আমবাগান আবহাওয়া অফিস ৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ উজ্জ্বল কান্তি পাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রামে চলতি মাসে ৫৩০ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এর মধ্যে গত সাতদিনে ৬০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এটা অবশ্যই রেকর্ড বৃষ্টি। আগামী ১৩-১৪ (আগস্ট) তারিখের দিকে ফের ভারী বৃষ্টি হতে পারে। তবে আগামী তিন-চারদিন বৃষ্টিপাত কম থাকবে।’
উপকূলীয় এলাকায় ঝোড়ো হাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় সমুদ্রবন্দর থেকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত প্রত্যাহার করেছে আবহাওয়া অফিস। নদীবন্দরগুলোকে এক নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম