ভূগর্ভ থেকে তোলা হচ্ছে অত্যাধিক পানি, হুমকিতে বরেন্দ্র অঞ্চল
১৩ আগস্ট ২০২৩ ০৮:৫৭
রাজশাহী: বরেন্দ্র অঞ্চলে কয়েক দশক ধরে অত্যাধিক পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির উপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এই অঞ্চলের ৪০ শতাংশেরও বেশি ইউনিয়নে খাবার ও সেচের পানির অভাব দেখা দিয়েছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ওয়াটার রিসোর্সেস প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষে ইনস্টিটিউট অফ ওয়াটার (আইডব্লিউএম) সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানির সম্পদের অবস্থার জলবিদ্যা তদন্ত এবং মডেলিং’ শীর্ষক গবেষণাটি করেছে আইডব্লিউএম। ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ২৫টি উপজেলায় এই সমীক্ষা চালানো হয়।
বাংলাদেশ সরকার এবং সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের যৌথ অর্থায়নে সমীক্ষাটি হয়। এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন আগামী সপ্তাহে প্রকাশিত হবে বলে জানিয়েছে ওয়ারপো রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আল-আমিন কবির ভূঁইয়া।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বরেন্দ্র অঞ্চলের ২১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে অন্তত ৮৭টি ‘খুব উচ্চ এবং উচ্চ পানির চাপযুক্ত এলাকা’। যার অর্থ তাদের পানি শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই অঞ্চলে গড় ভূগর্ভস্থ জলের স্তর, যা দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় ভৌগোলিকভাবে সামান্য উঁচু। গত তিন দশকে ৮ মিটার থেকে ১৮ মিটারে নেমে এসেছে পানির স্তর।
১৯৯০ সালে ব্যাপকভাবে ভূগর্ভস্থ জলের বিমূর্ততা এবং শুষ্ক মৌসুমে সেচের আগে এই অঞ্চলে গড় ভূগর্ভস্থ পানির টেবিলের গভীরতা প্রায় ৮ মিটার ছিল। গোমস্তাপুর এবং তানোর উপজেলায় ২১ মিটার পর্যন্ত পৌঁছেছিল। পানীয়, সেচ, মৎস্য চাষ এবং শিল্পের মতো বিভিন্ন উদ্দেশে অত্যধিক জল উত্তোলনের কারণে ২০১০ সালের মধ্যে গড় ভূগর্ভস্থ পানির টেবিলের গভীরতা ১৫ মিটারের নীচে নেমে গিয়েছিল। ২০২১ সালে এই অঞ্চলের একটি বিস্তীর্ণ এলাকায় গড় ভূগর্ভস্থ জলের গভীরতা ১৮ মিটারে পৌঁছেছিল, যখন গোমস্তাপুর উপজেলার মতো কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় তা ৪৬.৮৭ মিটারে নেমে আসে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অঞ্চলটি প্রধানত একক বা ডবল অ্যাকুইফার নিয়ে গঠিত। কয়েকটি বাইরের অঞ্চল বাদে যেখানে একাধিক জলজ রয়েছে। ভূগর্ভস্থ জলে ভরা ছিদ্রযুক্ত শিলা বা পলির দেহকে জলজ বলে পরিচিত। যখন বৃষ্টি হয়, ভূগর্ভস্থ পানি মাটির মধ্য দিয়ে জলাশয়ে প্রবেশ করে। স্প্রিংস এবং কূপের মাধ্যমে জলজ থেকে পৃষ্ঠ হতে পারে।
উদ্বেগজনকভাবে পোরশা ও সাপাহার উপজেলার চাওর, গাঙ্গুরিয়া, এবং তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের ৩০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত ড্রিলিং করার জন্য উপযুক্ত কোনো জায়গা পাওয়া যায়নি।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার বাধাইড় ইউনিয়ন, নাচোল, গোমস্তাপুর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার কিছু অংশে মাত্র একটি পাতলা জলজ, যার পুরুত্ব ৬ থেকে ১৬ মিটার, ৪২৬ মিটার গভীরতায় পাওয়া গেছে। এই পাতলা জলজই এই এলাকার জন্য পানির একমাত্র উৎস।
সমীক্ষায় বাইকার্বনেট, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ এবং আর্সেনিকের উচ্চতর মাত্রাও পাওয়া গেছে বেশিরভাগ ভূগর্ভস্থ পানির নমুনায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে কারণ গড় বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার কারণে ভূগর্ভস্থ জলের সারণী বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী সময়ে তার আসল অবস্থান ফিরে পেতে ব্যর্থ হয়েছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির রিচার্জ প্রধানত মৌসুমি বৃষ্টিপাত এবং বন্যার সময় ঘটে। বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির রিচার্জের প্রধান উৎস শুধুমাত্র বৃষ্টিপাত কারণ এটি বন্যামুক্ত অঞ্চলে অবস্থিত। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে রাজশাহীর সারদায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল প্রায় ১,৬৫০ মিলিমিটার। ২০২১ সালে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত কমে ১০৫০ মিলিমিটার হয়েছে বলেও গবেষণায় বলা হয়েছে।
বরেন্দ্রভূমির পুরু, আঠালো কাদামাটি পৃষ্ঠটি একটি অ্যাক্যুইটার্ড হিসেবে কাজ করে, একটি ভূতাত্ত্বিক গঠন বা স্তর যা একটি জলজভূমির সংলগ্ন থাকে এবং এটি শুধুমাত্র অল্প পরিমাণ তরলকে যেতে দেয়। এই অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জলের সারণী ক্রমাগতভাবে সেচের জন্য জল প্রত্যাহার বৃদ্ধির সঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে বলেও গবেষণায় বলা হয়েছে।
ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমাতে সমীক্ষায় বিদ্যমান ভূপৃষ্ঠের জলাশয় যেমন পুকুর, বিল এবং খাল পুনঃখননের সুপারিশ করা হয়েছে। ফসল বৈচিত্রকরণ, যার মধ্যে এইচওয়াইভি বোরোর পরিবর্তে কম জলের প্রয়োজনে ফসল চাষ করার কথাও বলা হয়েছে।
রাজশাহী বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশীদ বলেন, ‘শুধু বরেন্দ্র অঞ্চল না দেশের বিভিন্ন স্থানে পানির স্তর নেমে গেছে। রংপুর, ঠাকুরগাঁতেও পানি নেমেছে। ঢাকার অবস্থা আরও ভয়াবহ। এরকম সমীক্ষা সারাদেশেই প্রয়োজন। শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলে কেন? পানির স্তর নেমে গেলে বলা হয়েছে চাষাবাদ কমিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এই অঞ্চলে তা সম্ভব না। এই অঞ্চলে প্রধান হচ্ছে কৃষি কাজ করা। ধান চাষ এখানে সবচেয়ে বেশি হয়। এজন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। পরিকল্পনা নাহলে পানির স্তর আরও নেমে যাবে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, ‘কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় নিরাপদ ও ব্যবহারযোগ্য পানির চাহিদা সরবরাহের চেয়ে বেশি হলে পানির চাপ বা ঘাটতি দেখা দেয়। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জল শুধুমাত্র শুষ্ক মৌসুমের ফসলের মূল্যের কারণে নয় বরং বিপুল সংখ্যক মানুষের অভ্যন্তরীণ জল সরবরাহের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পুরো বরেন্দ্র অঞ্চল অচিরেই ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘উচ্চ বরেন্দ্রভূমির প্রধান সমস্যা ছিল ভূপৃষ্ঠের পানির কুল। একদিকে চাষের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি তোলা হচ্ছে অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির টেবিল রিচার্জ করা হচ্ছে না। ফলে পানির তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে। চাষাবাদের ধরণ পরিবর্তন করতে না পারলে প্রথমেই পানীয় জলের সংকটে পড়তে হবে এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের।’
সারাবাংলা/এমও