খুনিদের মাথায় ‘রাজমুকুট’ দিয়েছিলেন জিয়া-এরশাদ-খালেদা
১৪ আগস্ট ২০২৩ ১৮:০৪
ঢাকা: পৃথিবীর যে রাজনীতির ইতিহাস, তার পরতে পরতে অনেক কলঙ্কজনক অধ্যায় আছে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসেও বেশ কয়েকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে। এর মধ্যে নিকৃষ্টতম অধ্যায় হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড।
পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া এ ধরনের ঘটনার নেপথ্য নায়কদের পরিচয় ও স্বরূপ উদ্ঘাটনে সাধারণত যুগের পর যুগ কেটে যায়। বিশেষ করে যারা কিলিং মিশনে থাকে, তাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, ‘অপারেশন সাকসেসফুল’ হওয়ার পর ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা চিরজীবনের জন্য আত্মগোপনে চলে যান, অথবা সুনির্দিষ্ট ‘ক্লু’ না থাকায় আপাত চিহ্নিত খুনিরা আইনের ফাঁক-ফোকর গিলে বেরিয়ে যান।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ওপরে উল্লেখিত দুটি ধারণার কোনোটিই প্রযোজ্য নয়। কারণ, খুনিরা তাদের মিশন শেষ করে ‘বীরদর্পে’ জাতীয় বেতারে ‘খুনের ঘোষণা’ দেন এবং রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলার মাটিতে বুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ান, বাংলাদেশের হয়ে বিদেশি মিশনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
অর্থাৎ খুনিদের আত্মগোপনে যেতে হয়নি। আইনের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে বের হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। এখন প্রশ্ন— এমনটি কেন হলো? এর সহজ উত্তর হতে পারে— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর যারা ক্ষমতায় বসেছে, তারা মনেপ্রাণে ছিল বাংলাদেশবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী— এক কথায় পরাজিত শক্তির মদত ও সমর্থনপুষ্ট গোষ্ঠী।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়— বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যারা পুনর্বাসন করেছে তাদের কারও কারও নামের সঙ্গে বীর উত্তম, বীর বিক্রম, বীর প্রতীক খেতাব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বীর উত্তম খেতাব পাওয়া মেজর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে চাকরি ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছিলেন। খালেদা জিয়ার আমলেও এ ধারা অব্যাহত ছিল।
১৯৭৬ সালের ৮ জুন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মধ্যে ১২ জনকে বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়। এদের মধ্যে শরিফুল হক ডালিমকে (মেজর ডালিম) করা হয়েছিল চীনের প্রথম সচিব, খুনি আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব, বজলুল হুদাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সচিব, শাহরিয়ার রশীদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব, রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব, নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব, শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব, কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব, খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব, নাজমুল হোসেন আনসারকে কানাডায় তৃতীয় সচিব এবং আবদুল সাত্তারকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বেদনাদায়ক হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নিয়োগপত্র ঢাকা থেকে লিবিয়ায় পৌঁছে দিয়েছিলেন শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি নিজেও বীর উত্তম খেতাব পাওয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা। এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরবর্তী সময় বিএনপিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ পান। অধুনা তিনি বিএনপির সঙ্গে হিাসব-নিকাশ মিটিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে আছেন। সুযোগ পেলে হয়তো আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়বেন— এ দেশের রাজনীতিতে যা মোটেও অসম্ভব নয়।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ‘ফরেন সার্ভিস’ ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি মিশন ও দূতাবাসে উল্লেখিত ১২ সেনা কর্মকর্তা ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রধান দুই হোতা সৈয়দ ফারুক রহমান ও খন্দকার আব্দুর রশীদ চাকরি না নিয়ে ব্যবসা করার ইচ্ছা পোষণ করলে তাদের এই খায়েশ পূরণে জিয়াউর রহমান তাদেরকে ব্যবসার মূলধন জোগার করে দেন।
পরে জিয়াউর রহমানের সহযোগিতা ও লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির তরফ থেকে পাওয়া মূলধন দিয়ে খুনি খন্দকার আবদুর রশিদ ত্রিপোলিতে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি গড়ে তোলেন। আর সৈয়দ ফারুক রহমান লিবিয়ায় জনশক্তি রফতানি কোম্পানি খোলেন। এই কোম্পানি জিয়া ও এরশাদের শাসন আমলে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় জনশক্তি নিত।
শুধু চাকরি আর ব্যবসায় মূলধন দিয়ে নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসনে জিয়াউর রহমানের বিএনপি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। প্রয়াত স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টিও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এরশাদের শাসন আমলে ১৯৮৭ সালের ৩ আগস্ট লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির পৃষ্ঠপোষকতায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ ও কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ঢাকার হোটেল শেরাটনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে ফ্রিডম পার্টি গঠন করেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যার একযুগ পর শোকের মাসের তৃতীয় দিন বাংলার মাটিতে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক দল গঠন করে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা।
ফ্রিডম পার্টি চলত মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির টাকায়। এ ছাড়া বংলাদেশ-লিবিয়া ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি গড়ে তোলেন খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান ও খন্দকার আবদুর রশিদ। ঢাকায় ব্রাদার গাদ্দাফি কিন্ডারগার্টেন স্কুলও খোলেন তারা। আর গাদ্দাফির লেখা ‘গ্রিন বুক’ বাংলায় অনুবাদ করে জনসাধারণের মাঝে ফ্রি বিতরণের ব্যবস্থাও করেন এ দুই খুনি।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে— ‘দুধ-কলা দিয়ে সাপ পোষা’। পরম যত্নে বঙ্গবন্ধুর যে খুনিদের জিয়া লালনপালন করেছেন, সেই খুনিদেরই একটি অংশ ১৯৮০ সালের ১৭ জুন সেনানিবাসের অভ্যন্তরে অভ্যুত্থানের অপচেষ্টা চালায়। সেই সময় মেজর ডালিম-নূর-হুদা-আজিজ পাশাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে অবশ্য নানা বিবেচনায় মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেন জিয়াউর রহমান।
১৯৮৬ সালের নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে খুনি ফারুক রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ওই নির্বাচনের পোস্টারে লেখা ছিল— ‘আগস্ট বিপ্লবের মহান নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী
ক. ফারুকের ঐতিহাসিক জনসভা আজ রোববার ১২ অক্টোবর রফতানি মেলা মাঠ, শেরেবাংলা নগর। দলে দলে যোগ দিন।’ খুনি ফারুক রহমানের নির্বাচনি প্রতীক ছিল বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষের মতো।
প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তিকে দাঁড় করানোর লক্ষ্যে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রাজনীতিতে সক্রিয় করার চেষ্টা করেছিল। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে খুনি বজলুল হুদাকে মেহেরপুর থেকে সংসদ সদস্য বানানো হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে বিএনপির একতরফা নির্বাচনে খুনি রশীদকে বিরোধীদলীয় নেতা মনোনীত করা হয়েছিল।
এই নাতিদীর্ঘ আলোচনা থেকে মোটামুটি এটুকু পরিষ্কার, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মাথায় ‘রাজমুকুট’ পরানোর ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের অবদান সবচেয়ে বেশি। আবার গত একযুগ ধরে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র জাতীয় পার্টির অবদানও কম নয়। পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়াও তার ‘বিতর্কিত’ সংসদে খুনি রশীদকে বিরোধীদলীয় নেতা মনোনীত করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ‘রাজমুকুটে’ আরেকটি পালক সংযোজন করেন। বিদেশি শক্তির মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এ নোংরা কাজে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করে। এর পেছনে তারা ঢের অর্থ ব্যয় করেছে। এ ক্ষেত্রে লিবিয়ার স্বৈরশাসক প্রয়াত মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি ছিলেন সবচেয়ে এগিয়ে ছিল।
সারাবাংলা/এজেড/টিআর