Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গবন্ধু হত্যায় সাক্ষীদের কাছ থেকে বারবার এসেছে জিয়ার নাম

আজমল হক হেলাল
১৪ আগস্ট ২০২৩ ২৩:৫১

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা মামলার বিচার কাছ থেকে দেখেছি। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আদালতের বিচার কার্যক্রম দেখার ও সংবাদ সংগ্রহ করার সুযোগ হয়েছে। এখন মনে প্রশ্ন জাগে— হত্যার পেছনে নেপথ্যে যেসব কুশলীব ছিল, তাদের বিচার কি দেখে যেতে পারব?

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনায় কুশীলবিদের চিহ্নিত ও বিচার করার জন্য একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দীর্ঘ দিনের। সে জন্য একটি আইন প্রণয়নের কার্যক্রমও শেষ পর্যায়ে। আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমতি দিলেই কমিশন গঠনের আইনটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে। মন্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথন থেকে ইঙ্গিত মিলেছে, আইনটি হয়তো আগামী অধিবেশনে উত্থাপন হতে পারে সংসদে।

জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম শুরু হলে সে মামলায় প্রধান আইনজীবী ছিলেন বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা আ্যাডভোকেট সিরাজুল হক। দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীরাই বলেন, প্রবীণ ও অভিজ্ঞ এই আইনজীবী হত্যা মামলাটি পরিচালনায় অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

সেই আ্যাডভোকেট সিরাজুল হক ছিলেন জাতির জনকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার বিচারকাজ শুরুর পর আদালত প্রাঙ্গণে বিচারিক কার্যক্রমের বিরতিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক গল্প বলতেন তিনি। অনেক সময় স্বগতোক্তির মতো করে বলতেন, ‘আমার বন্ধুর হত্যার বিচার শেষ করে বিচারের রায কার্যকর কি আমি দেখে যেতে পারব? দেখে যেতে পারলে মহাখুশি হব। আমার কোনো আফসোস থাকবে না।’

বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারে আইনি লড়াই শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। আমি তখন দৈনিক রুপালীতে স্টাফ রিপোর্টার। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সব নেতা ফকিরাপুলে দৈনিক রুপালী অফিসে গিয়ে ইউনিট কমিটি গঠন করেন। আমাকে করা হয় ইউনিট চিফ, সালেহ বিপ্লবকে করা হয় ডেপুটি চিফ ইউনিট। আমাকে কেন ইউনিট চিফ করা হলো, অনেকটা সে কারণেই আমাকে ‘শাস্তিমূলকভাবে’ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার খবর সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হলো।

তখন দৈনিক রুপালীর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন মাহফুজুর রহমান মিতা (বর্তমান সংসদ সদস্য, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা দ্বীপবন্ধু মোস্তাফিজুর রহমানের বড় ছেলে)। চিফ রিপোর্টার ছিলেন কুদ্দুস আফ্রাদ (ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি)। একদিন রাত ১১টায় বার্তাকক্ষে নির্বাহী সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মিতা এসে কুদুস আফ্রাদ ভাইকে বললেন, কাল থেকে হেলালকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামালার কার্যক্রম কাভার করার জন্য অ্যাসাইনমেন্ট দেবেন। এই মামলার বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওকে অ্যাসাইনমেন্টে বহাল রাখবেন।

নির্বাহী সম্পাদকের আদেশ, অমান্য করার উপায় নেই। হয় আমাকে অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে হবে, না হয় চাকরি ছাড়তে হবে। প্রথমে বুকটা কেঁপে উঠল, কার সাহায্য নেব? স্পটে গিয়েই আমাকে অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে হবে। অ্যাসাইনমেন্ট ছিল যেহেতু শাস্তিমূলক, তাই রিপোর্ট মিস করলেই চাকরি নেই। তবু মনে সাহস রেখে চাকরিরক্ষার জন্যই প্রস্তুতি নিলাম।

পরদিন সকালে অফিস আদেশ পালন করতে একটি ছোট নোট বই নিয়ে সকাল ৯টার আগে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে চলে যাই। বিশেষ ট্রাইব্যুনালটি ছিল কেন্দ্রীয় কারাগারসংলগ্ন। এ আদালতেই চলবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার। আদালতে ঢুকতেই গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমার নাম লিখে নিল। এরপর দেহ তল্লাশি করে পাঠাল দোতলায়।

আমি দোতলায় গিয়ে এজলাস কক্ষে ঢুকেই দেখতে পেলাম বন্ধু মাহমুদুর রহমান খোকনকে। এখন দৈনিক করতোয়ার বার্তা সম্পাদক। ওই সময় তিনি বার্তা সংস্থা আবাস-এ স্টাফ রিপোর্টার ছিল। আমাকে দেখেই মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে পাশে বসতে বললেন। ওর পাশে চুপ করে বসে পরিস্থিতি দেখছি আর ভাবছি। আমাদের পাশে অন্য পত্রিকার সাংবাদিকরাও রয়েছেন। এর মধ্যে আমাদের সবার শ্রদ্বেয় মনোজ রায়, তিনিও বাসসের প্রতিনিধি হিসেবে রিপোর্টিং করতে কক্ষে উপস্থিত।

একটু পরেই পুলিশের তৎপরতা। বাঁশির হুইসেল। বন্ধু খোকন বললেন, আসামিদের নিয়ে আসছে। এরপরই দেখি পায়ে ডান্ডাবেড়ি ও হাতে হাতকড়া পরা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনি ও মামলার প্রধান আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দীন ঠাকুরসহ অন্য আসামিদের পুলিশ পাহারায় নিয়ে আসা হয়েছে। আসামিদের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একটি প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে আসা হয়।

আসামিরা এজলাস কক্ষে ঢুকে আমাদের পেছেন টুলে বসেন। ৫ মিনিট পরেই আদলতে একজন ব্যক্তি ঘোষণা দিলেন, মাননীয় বিচারক আসছেন। কালো গাউন পরা বিচারক গোলাম রসুল এজলাসে তার আসনে বসলেন। শুরু হলো সাক্ষীদের জেরা। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন। আমি নোট নিতে পারছিলাম না। কারণ আমার কাছে ছোট নোট বই। আর সবার কাছে বড় সাদা কাগজ। তারা সঙ্গে একটি বোর্ড নিয়েছেন। বোর্ডের ওপর সাদা কাগজ রেখে তারা লিখছিলেন।

ওই দিন আমাকে রিপোর্টিংয়ের সাহায্য করেন বন্ধু মাহমুদুর রহমান খোকন। পরদিন আমিও সাদা কাগজ আর বোর্ড নিয়ে আদালতে চলে যাই। নোট নিই। বিকেলে আদালতে কার্যক্রম শেষ হয়, অফিসে চলে আসি। ইন্ট্রোর সঙ্গে প্রশ্ন-উত্তর ধাঁজে ছাপা হতো পুরো প্রতিবেদন।

যেদিন আদালতে মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাকে জেরা করা হয়, সেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনি ফারুক রহমানের কৌঁসুলী আ্যাডভোকেট খান সাইফুর রহমান খুবই দক্ষতার পরিচয় দেন। শুরুতই তিনি শফিউল্লাহকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কি লেখাপড়া জানেন? সাক্ষী শফিউল্লাহ কাঠগড়ায় অনেকক্ষণ চুপ থাকেন।

এ সময় আ্যাডভোকেট খান সাইফুর রহমান বিচারক গোলাম রসুলকে বলেন, স্যার লিখুন, আপনি কি লেখাপড়া জানেন? সাক্ষী চুপ। এ বিষয়টি আদালতকে নোট করতে হবে। কারণ উচ্চ আদালতে এই পয়েন্টটি আমার প্রয়োজন হবে।

এ সময় বিচারক গোলাম রসুল সাক্ষীর উদ্দেশে বলেন, শফিউল্লাহ সাহেব, আ্যাডভোকেট আপনাকে যা জিজ্ঞাসা করবে তার জবাব আপনাকে দিতে হবে। আবার খান সাইফুর রহমান জেনারেল শফিউল্লাহকে প্রশ্ন করেন, আপনি কি লেখাপড়া জানেন? এ সময় শফিউল্লাহ জবাব দেন, ‘হ্যাঁ জানি।’ তখন যাহা বলিব সত্য বলিব…— আদালতের এই হলফনামা দেখিয়ে আ্যাডভোকেট খান সাইফুর বলেন, ‘তাহলে এই লেখাটি পড়ুন।’ জেনারেল শফিউল্লাহ লেখাটি পড়েন। এ সময় আদালতে উপস্থিত অন্য আসামিরা মুচকি হাসছিলেন।

পরে জেনারেল শফিউল্লাহকে জিজ্ঞাসা করা হয় সেনা সদরে তার বাসা কোন জায়গায় অবস্থিত, ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাতে তিনি কোথায় ছিলেন, ওই দিনগত রাতে অর্থাৎ ১৫ আগস্ট ভোরে তিনি ট্যাংকের শব্দ পেয়েছেন কি না, বঙ্গবন্ধু ফোন করলে তিনি রিসিভ করেছিল কি না ইত্যাদি।

মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৪৫ নম্বর সাক্ষী। তিনি জবানবন্দিতে বলেন, তার ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের যোগ্যতা একই রকম থাকলেও জিয়া সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু জেনারেল ওসমানীর পরে ১৯৭২ সালে জিয়াউর রহমানের জায়গায় শফিউল্লাহকে চিফ অব আর্মি স্টাফ করলে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলে তিনি বলেন, ‘তোমার কথা শুনেছি। দেয়ার ইজ সামথিং কলড পলিটিক্যাল ডিসিশন।’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘ফ্রম টুডে অ্যান্ড নাউ অনওয়ার্ডস, আই অ্যাম আ ভিকটিম অব সারকামস্ট্যান্সেস।’ এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যাও, কাল তুমি জেনারেল ওসমানীর নিকট হইতে দায়িত্ব বুঝিয়া নাও।’ এরপর অফিসে গিয়ে প্রথমে কুমিল্লায় জিয়াউর রহমানকে ফোন করেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপের বিস্তারিত জানান। কথা শোনার পর জিয়া বলেন, ওকে শফিউল্লাহ, গুড বাই।

শফিউল্লাহর জবানবন্দি বলছে, সপ্তাহখানেক পর একটি নতুন পদ ‘ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ’ তৈরি করে ওই পদে জিয়াউর রহমানকে পদায়ন করা হয়। এই পদ পাওয়ার পরও তার মনে ক্ষোভ থেকে যায়। রক্ষীবাহিনী গঠিত হওয়ার পর এই বাহিনী নিয়ে কিছু মহল বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে এবং সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসেবে রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছে বলে বিভ্রান্তি ছড়ায়। এ ছাড়া অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর অফিসার মেজর ডালিম তার ছাত্রজীবনের কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটান।

জবানবন্দিতে সাবেক সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ বলেন, ১৯৭৩ সালে এক বিয়েতে গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলের সঙ্গে তার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এর জের হিসেবে তিনি কিছু সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে গাজী গোলাম মোস্তফার বাড়িতে হামলা করেন। এ কারণে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ জিয়ার পিএস মেজর নূর সরকারের বিরুদ্ধে কিছু আক্রমণাত্মক মন্তব্য করলে তাকেও চাকরি থেকে অব্যাহিত দেওয়া হয়। এতে কিছু মহল সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে শুরু করে এবং সেই অপপ্রচারে সেনাবাহিনীর মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়।

একপর্যায়ে শফিউল্লাহ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কাঠগড়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন। মূলত আইনজীবীর প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি তার কর্তব্যে অবহেলার বিষয়টি পরিষ্কার করে ফেলেন। হত্যা মামলার রায়ের দিন গোলাম রসুল এজলাসে দাঁড়িয়ে রায় পড়ে শোনানোর সময় বলেন, ‘শফিউল্লাহকে আসামি না করে সাক্ষী করা রাষ্ট্রপক্ষের ঠিক হয়নি।’

আদালতে একদিন অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের নেয়া ফারুখ রশিদের সাক্ষাৎকারের ভিডিও দেখানো হয়। এ সময় বিচারপতি গোলাম রসুল অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুখ রহমানের আইনজীবী খান সাইফুর রহমানকে বলেন, ‘খান সাহেব, এরপরও কী সাক্ষীদের জেরা করা প্রয়োজন?’ খান সাইফুর রহমান এজলাসের বাইরে পায়চারি করছিলেন। তিনি বিচারকের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি ভিডিও দেখিনি। ওটি আমি দেখার প্রয়োজন মনে করি না।’
পরে বিচারক গোলাম রসুল আসামি ফারুখ রহমানকে বলেন, ‘ভিডিওটিতে যে ছবি দুটি দেখা যাচ্ছে, ওই ছবির দুজনকে আপনি চেনেন?’ কর্নেল ফারুখ দাঁড়িয়ে জবাব দেন, ‘হ্যাঁ, চিনি। একজন আমি নিজে, আরেকজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) রশিদ।’ ওই সাক্ষাৎকারে ফারুখ ও রশিদকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা স্বীকার করতে এবং ১৫ আগস্টের ঘটনার বর্ণনা দিতে দেখা যায়।

আরেক দিন একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে জেরা করা হয়। ওই সেনা কর্মকর্তার নাম আমার মনে নেই। তিনি জানান, ১৫ আগস্ট রাতে তার ডিউটি ছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। খুনিরা বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করার পর শেখ রাসেলকে ভবনের নিচে নিয়ে যায়। ওই সময় শেখ রাসেল কান্না করছিল আর বলছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’ তখন খুনিদের একজন শেখ রাসেলকে হত্যা করার ইঙ্গিত দিলে একজন সিপাহি রাসেলকে ভবনের সিঁড়ির কাছে গুলি করে হত্যা করে।

এ সব ঘটনা ছাড়াও ওই দিন কর্তব্যরত সেনা সদস্য সাক্ষীরা আদালতে জানিয়েছেন, ১৫ আগস্টের আগের রাতে অর্থাৎ ১৪ আগস্ট রাতে ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যারা ডিউটি করছিলেন, সেসব কর্তব্যরত সেনা সদস্যদের অস্ত্রের গুলি সন্ধ্যার পর নিয়ে নেওয়া হয়।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হামিদ (সাবেক ফুটবলার কায়সার হামিদের বাবা) ১৯৭৫ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের স্টেশন কমান্ডার ছিলেন। জেরার সময় তিনি আদালতকে জানান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদ, শাহরিয়ার রশিদসহ অন্যান্য জুনিয়র অফিসাররা ক্যান্টনমেন্ট লন টেনিস কোর্টের কাছে যেতেন। ওই সময় মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ বিষয়টি নিয়ে কর্নেল হামিদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। শাহরিয়ার রশিদ, কর্নেল ফারুক রহমান ও মেজর ডালিমের কাছে কর্নেল হামিদ জানতে চান, তারা কেন সেখানে যান। তারা কর্নেল হামিদকে জানান, জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে যান। জিয়া তাদের যেতে বলেছেন। জেনারেল শফিউল্লাহ ওইসব অফিসারদের সেখানে যেতে নিষেধ করে দিতে কর্নেল হামিদকে নির্দেশ দেন।

এ ছাড়া ১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর পোশাক সম্পর্কে আদলতে জেরার মুখে একজন সাক্ষী জানান, বিপথগামী চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তাদের পোশাক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ কর্নেল ফারুক রহমানের মাধ্যমে সরবরাহ করেন জিয়াউর রহমান।

আদালতে বিচারকাজ চলত একটানা দুপুর পর্যন্ত। এরপর আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টার জন্য বিরতি দেওয়া হতো। এ সময় আসামিদের আত্মীয়-স্বজনরা তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। তারা খাবার নিয়ে গেলে সেই খাবার খেতেন। আসামি তাহের উদ্দিন ঠাকুর, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মহিউদ্দিন তসবি পড়তেন। রশিদ শাহরিয়ার পান চিবুতেন আর তার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতেন। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুখ রহমান তার বৃদ্ধ মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারকাজ চলাকালীন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মামলা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করতেন। একদিন একটি রিপোর্টকে কেন্দ্র করে একটি পত্রিকায় রিপোর্টারের ওপর চড়াও হন আসামিপক্ষের আইনজীবী। একপর্যায়ে আদালতে সাংবাদিক বনাম আইনজীবীদের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। ওই সময় গোলাম রসূল এজলাস থেকে নেমে যান।

১৪৮ দিন শুনানি শেষে মামলার বিচারক কাজী গোলাম রসুল ৮ নভেম্বর মামলার রায় ঘোষণা করার দিন ঠিক করেন। রায় ঘোষণার দিন বিচারক দুপুর ১টায় এজলাসে ওঠেন এবং রায় পড়ে শোনান। এ সময় হত্যা মামলায় গ্রেফতার খুনিরা সবাই এজলাসে উপস্থিত ছিলেন। তাদের সবার হাতেই ছিল তসবি।

বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার এই বিচারকাজের আগের প্রক্রিয়াটিও সহজ ছিল না। বরং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন দেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালে সেই ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। এর মধ্য দিয়েই সুগম হয় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার পথ।

শেষ পর্যন্ত ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড সাজা দেন। পরে আসামিরা হাইকোর্টে গেলে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় দেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি সেটি তৃতীয় বেঞ্চে পাঠালে সেখানে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।

এরপরও জটিলতা কাটেনি। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচারকাজ বন্ধ থাকে। দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে পাঁচ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতির লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।

পরে ২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির আপিল আবেদন খারিজ করেন। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি পাঁচ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। পরে ২০২০ সালে ফাঁসি কার্যকর করা হয় আরও এক আসামির। পাঁচ আসামি এখনো পলাতক।

লেখক: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা ডটনেট

সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর

১৫ আগস্ট জাতির পিতা টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর