১৫ আগস্ট: যে রাতের পর ভোর হয়নি
১৫ আগস্ট ২০২৩ ০০:০০
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্ম নেওয়া খোকাটির বয়স তখন ৫৫ বছর পাঁচ মাস। এ মাটির ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে, এ মাটিকে ভালোবেসে, মাটি ও মানুষের ভালোবাসায় খোকা থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জাতির পিতা’ হয়ে ওঠা মানুষটি তখন কড়া নিরাত্তা বলয়ের মধ্যে বঙ্গভবনে গিয়ে থাকতে পারতেন। কিন্তু যিনি যৌবনে পদার্পণের আগেই পুরো জাতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন, সেই তিনি মহিরুহতে পরিণত হওয়ার পর জনবিচ্ছিন্ন হয়ে দলের নেতা-কর্মীদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে গিয়ে শুধু নিজের জন্য বাঁচবেন কেন!
সেই সুযোগটা নিতে ভুল করেনি স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের দালালরা। ফলে স্বাধীনতার মাত্র পৌনে চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিকের হাতে সপরিবারে জীবন দিতে হয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। থামিয়ে দেওয়া হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা।
সকাল হলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল তার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ ‘ডাকসু’ সব ধরনের প্রস্তুতিও নিয়েছিল। ছাত্র সংসদের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল সে আয়োজনে গায়ে-গতরে খেটেছেন রাত অবধি। তারপর ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম থেকে যেতে পীড়াপীড়ি করা সত্ত্বেও গভীর রাতে বাড়ি ফিরেছিলেন নববিবাহিত শেখ কামাল। ঘরে ফেরার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ঘাতকের প্রথম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন তিনি। ঘাতকের বুলেট প্রাণ কেড়ে নেয় তার। বঙ্গবন্ধুর কাছে এ সংবাদটা পৌঁছানোর পর তার বিস্ময়কাতর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘ওরা কামালকে মেরে ফেলেছে!’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে ঘাতকরা কেবল শেখ কামালকে নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আগে-পরে তার স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, বাকি দুই পুত্র শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হককেও হত্যা করে।
প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগনে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি এবং বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খানকে হত্যা করে।
১৫ আগস্ট রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে একটি দলের প্রধানকে হত্যা করা হয়েছিল— বিষয়টি মোটেও এমন নয়। হত্যার ধরন ও লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ থেকে পরিষ্কার হয়, বঙ্গবন্ধুর বংশকে ঝাড়ে-বংশে নির্বংশ করার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে চিরদিনের জন্য নির্মূল করে দেওয়াই ছিল খুনিদের মূল উদ্দেশ্য। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে ঘাতকের বুলেট ১০ বছরের শিশু থেকে অন্তঃসত্ত্বা নারী— কাউকে রেহাই দেয়নি। বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন— ঢাকায় যে যেখানে ছিল, সবাইকে বেছে বেছে হত্যা করা হয়। দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা।
সেদিন সকাল ৭টার মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সবাইকে ঘাতকরা ধানমন্ডির বাড়িতে হানা দিয়ে একের পর এক হত্যা করেছে। তখনো ঘরের মধ্যে পড়ে আছে রক্তাক্ত মৃতদেহগুলো। আর সেই সময় অন্য কেউ নয়, মুজিব সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলছেলন ক্ষমতার মসনদের দিকে। মুক্তিযুদ্ধের ময়দান থেকে যে ষড়যন্ত্রটি তিনি সতর্কতার সঙ্গে করে যাচ্ছিলেন, আজ তা সফল হলো।
২১৮ বছর পর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল। এমনি বিশ্বাসঘাতকার ইতিহাস পলাশীরও। সেদিনও এক বাইরের শক্তি চক্রান্ত করে বাংলার নবাব সিরাজ উদ-দৌলাকে গদিচ্যুত করে বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরকে মসনদে বসায়। এবারও দেশি-বিদেশি শক্তি চক্রান্ত করে বিশ্বাস ঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমেদকে ক্ষমতার মসনদে বসায় বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে।
খন্দকার মোশতাক যখন শপথ নিচ্ছিলেন, তখনো সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত মৃতদেহ ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে পড়ে আছে। আর কজন কাপুরুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে মন্ত্রী হওয়ার জন্য। ওদের লাইনে সামিল করা গেল না মুজিব মন্ত্রিসভার সদস্য সৈয়দ নজরুল, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আর এইচ এম কামরুজ্জামান— এই তিনজনকে। খন্দকার মোশতাক ওই তিনজনকে তখনই গ্রেফতার করার হুকুম দিলেন। সেই সঙ্গে আরও দুজন— তাজউদ্দীন আহমেদ ও আব্দুস সামাদকেও গ্রেফতার করতে বলা হলো।
মুজিবু পরিবার নিশ্চিহ্ন, তবুও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না, যতদিন এই পাঁচজন বাংলাদেশে থাকে। খন্দকার মোশতাক সব কাঁটা তুলে ফেলতে চান। জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণ দিলেন তিনি। তাতে জয়ধ্বনি দিলেন মুজিব হত্যাকারী মেজরদের। বললেন, ‘ওরাই নয়া জামানা পয়দা করল, ওরা সূর্য সন্তান।’
এভাবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে জঘন্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নবজাতক এক স্বাধীন দেশকে আবার বেঁধে ফেলা হলো দাসত্বের শৃঙ্খলে।
সারাবাংলা/এজেড/টিআর
১৫ আগস্ট জাতির পিতা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধুর খুনি শেখ কামাল শেখ জামাল শেখ ফজিলাতুননেসা শেখ মুজিবুর রহমান শেখ রাসেল শোক দিবস