Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আগস্ট হত্যাকাণ্ড: বর্তমানের দায়


১৫ আগস্ট ২০২৩ ১২:০৩

এক

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তার পরিবারের সদস্য এবং সহযোগীদের হত্যার খবরে হতবাক সারা বিশ্ব। সকালের বৈঠকেই ব্রিফ করা হলো জার্মানীর চ্যান্সেলর উইলী ব্রান্ডট্-কে। সব শুনে উইলী ব্রান্ডট্ বললেন, ‘যে জাতি শেখ মুজিবের মতো নেতাকে হত্যা করতে পারে সেই জাতিকে আর বিশ্বাস করা যায় না।’

একটি জাতির জন্য এর চাইতে বড় কলংকজনক, অসম্মানজনক আর কিছু হতে পারে না। অনেকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এই জাতি দায়মুক্ত হয়েছে। আমি বলি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এই জাতি যে পাপ করেছে তা থেকে এই জাতির কোনও দিন মুক্তি নেই। এই পাপ অমোচনীয়।

দুই

ইতিহাসে রাজ্য দখল বা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে, রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসার কারণে হত্যা ও রক্তপাতের অনেক নজির আছে। এসব ঘটনার শিকার হয়েছেন তিনিই, যাকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য অর্জন করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৭৫ সনে যা হয়েছে তাতে ক্ষমতা দখলের সংকীর্ণ লক্ষ্য অর্জনের চাইতেও অনেক বেশি কিছু ছিল। একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে নয় শুধু, নারী-শিশুসহ তার পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। রেহাই পায়নি অন্ত্বসত্তা নারী, দায়িত্ব পালনরত পেশাজীবী সেনা কর্মকর্তা এমনকি ঘটনাস্থলের অদূরে সাধারণ মানুষ। শুধু তা-ই নয়, সেই নেতার সম্ভাব্য সকল রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীদেরও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিবারের নিকটতম আত্মীয়দেরও রেহাই দেওয়া হয়নি। এই হত্যাকান্ডের পরপর খুনিরা শুধু রাষ্ট্রক্ষমতায়ই বসেনি, আইন করে হত্যার বিচার বন্ধ করেছে। রাতারাতি রাষ্ট্রের চরিত্রই পালটে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের গতিমুখ আমূল পালটে দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনায় নিহত প্রতিটি ব্যক্তি, মানুষ হিসেবে এবং বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ওই হত্যাকান্ডের শিকার শিশু, নববধূ ও গৃহবধূরা, গৃহ পরিচারিকা, নিরস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীসহ রাজনীতি থেকে দূরে থাকা নাগরিকরা যাতে বিচার না পান সে জন্য সমস্ত পথ বন্ধ করার তৎপরতা চালানো হয়েছে। আইন করে, বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত করে ২১ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিহতের পরিবারগুলোকে বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। হত্যাকারী ও তাদের মদতদাতাদের বক্তব্য বা অবস্থান থেকে এটি স্পষ্ট যে, তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পুনর্গঠনের উদ্যোগকে বঙ্গবন্ধুর মূল ‘অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেই ‘অপরাধের সাজা’ও তারা নির্ধারণ করে এবং বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে সে ‘সাজা’ কার্যকরের প্রথম পর্যায় সম্পন্ন করে। দ্বিতীয় ধাপে জাতীয় চার নেতাকে কারাকক্ষে হত্যা এবং তৃতীয় ধাপে সামরিক বাহিনীগুলো থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা ও বরখাস্ত করার মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়। কিছু সেনা সদস্যের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর সেই ‘অপরাধ’কে পরবর্তীতে ‘জাতির জন্য ক্ষতিকর’ চিহ্নিত করে বৃহত্তর পরিসরে পঁচাত্তর ও তৎপরবর্তী হত্যাকাণ্ডগুলোর যৌক্তিকতা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। একই যুক্তিতে আজও কিছু দল ও ব্যক্তি ওই ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডগুলোর বৈধতা দেয়ার চেষ্টায় তৎপর।

বিজ্ঞাপন

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, ‘অপরাধী’র (হত্যাকারির দৃষ্টিতে) পারিবারিক ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নির্মূল করা। এটি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে গোত্র সংস্কৃতির মধ্যে দেখা যায়, যা রাজতন্ত্রের অবসানের মধ্য দিয়ে বিশ্বের অধিকাংশ ভূখন্ডে অতীত হয়েছে। যেসব ‘রাজনৈতিক শক্তি’ ও ‘সুশীল সমাজে’র অংশগুলো (হাল আমলে তারা সংখ্যায় নগণ্য হলেও ক্রিয়াশীল) ওই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে, সাংস্কৃতিকভাবে তারাও আজ পর্যন্ত গোত্র সংস্কৃতিই লালন করে চলেছে। তারা নতুন করে গোত্র সংস্কৃতির উত্থান ঘটাতে তৎপর, যা বাঙালি জাতিসত্ত্বার উদ্ভব ও বিকাশের প্রক্রিয়ায় অতিক্রম করেছে বহু আগে। ফলে এই গোষ্ঠিটি প্রকৃতই আধুনিক সমাজের বা সিভিল সোসাইটির অংশ হতে পারে না।

এই দুটি হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ ও নেপথ্য কুশীলব এবং আজ পর্যন্ত ওই হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গাওয়া গোষ্ঠীর যুক্তি খন্ডন করা নয়, বরং একটি অন্যায়ের সাফাই গাওয়াও যে অপরাধ, কখনও কখনও তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সেটি সকল দায়িত্বশীল মহলকে বিশেষত: রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং রাষ্ট্রের আইন ও বিচার বিভাগকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া বর্তমানের একটি জরুরী দায়িত্ব।

প্রাথমিকভাবে এমনটি মনে করা হয়েছিল, সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্যের অপকর্ম এটি। কিন্তু চলমান ধারণার সুতো ধরে পথ চলতে গিয়ে মিলেছে বিশাল ষড়যন্ত্রের নকশা। দৃশ্যমান ঘাতকদের নেপথ্যে দেখা যাচ্ছে অনেক চরিত্রের সমাবেশ। এমনকি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অনেক খলনায়কদেরও দেখা মিলছে।

বিজ্ঞাপন

যারা ঘাতক, যাদের বিচার হয়েছে, যাদের ফাঁসি হয়েছে তাদের ঠিকুজি তো এখন সবার জানা। কিছু প্রমাণিত তথ্য জানান দিচ্ছে আরও অনেক চরিত্রের। পঁচাত্তরের আগস্ট হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যমান খুনিদের বিচারকাজের সকল প্রমাণিত দলিল, প্রকাশ্য সাক্ষ্য, নথিভুক্ত প্রামাণ্য নতুন চরিত্রের চেহারা উন্মোচন করছে। হত্যাকাণ্ডের সময়ের পরিস্থিতি একেবারে কাছে থেকে দেখেছেন এমন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের লিখিত বয়ান, নানা আন্তর্জাতিক সূত্রের তথ্য, দেশে বিদেশে নানা সংবাদমাধ্যমে খুনিদের সদম্ভে দেওয়া সাক্ষাৎকার, দেশী- বিদেশী অনেক সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের তথ্য এখন নিশ্চিত করছে আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিছক কয়েকজন সেনা সদস্যের হঠকারী সিদ্ধান্ত ছিলো না। বিষয়টি ছিল খুবই সুপরিকল্পিত। ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সময় এবং ঘটনার আগে ও পরে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের ভূমিকা এবং হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগীদের (বেনেফিশিয়ারি) দিকে তাকালে দেখা যাবে এই ষড়যন্ত্রের সুতো কতটা বিস্তৃত ছিল। এই হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে কার বা কাদের কী ভূমিকা ছিল, চিহ্নিত অপরাধীদের কারা, কীভাবে পুনর্বাসন করল, তাদের আইনি সুরক্ষা দিল এবং এমন এক বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য সাংস্কৃতিকভাবে কারা কী করেছে সে বিষয়টির নিবিড় অনুসন্ধান এবং দায় নিরূপন এখন সময়ের দাবি। বর্তমানকেই এই দায় নিতে হবে। এই নেপথ্য চরিত্রগুলোর অনেকেই রাষ্ট্রের অনেক বড়ো পদে আসীন হয়েছেন, ইতিহাসকেও ইচ্ছেমতো তৈরি করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ইতিহাসের সত্য বড়োই নির্মম ও শক্তিশালী। কোনও কারণে সেই সত্যকে হয়তো কিছু সময় চাপা দিয়ে রাখা যায়, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেই সত্য কোনও না কোনও সময় উচ্চকণ্ঠেই কথা বলে।

তিন

বঙ্গবন্ধু হত্যামামলার বিচার কালে আইনজীবী সিরাজুল হক এই হত্যাকাণ্ডের ‘কন্সপিরেটর’ হিসেবে খন্দকার মুশতাক এবং ‘ইন্সপিরেটর’ হিসেবে জিয়াউর রহমানকে চিহ্নিত করেছেন। বিশ্লেষণ বলে, কারও মদত ছাড়া ষড়যন্ত্র ভিত পায় না। কাজেই পনেরো আগস্ট হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে ‘কন্সপিরেটর’ ও ‘ইন্সপিরেটর’ এর যৌথ উদ্যোগেই। এখানে কারও দায় কম নয়।

আগস্ট হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা, দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও দেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই বাবা-মা-ভাই-ভ্রাতৃবধূ হত্যার বিচার চেয়েছেন। কোনও বিশেষ আইন নয়, দেশের প্রচলিত আইনেই বিচারটি হয়েছে। কিন্তু বিচার হয়েছে খুনের এবং খুনীদের, হত্যার ও ষড়যন্ত্রের বিচার এখনও বাকী। যে কোন খুন কোন ঘটনার তাৎক্ষনিক প্রক্রিয়াতেও হতে পারে কিন্তু একটি হত্যাকান্ড ঘটাতে পরিকল্পনা লাগে, দৃশ্যমান দুর্বৃত্ত ছাড়াও অনেক নেপথ্য কুশীলব লাগে।

চার

বর্তমানের যারা এই দায়িত্ব পালনে প্রকৃতই আন্তরিক ও আগ্রহী তাদের জন্য দুইটি সূত্র উল্লেখ করি।

প্রথম সূত্র: পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সকালে রেডিওতে খন্দকার মুশতাক ভাষণের প্রস্তুতি চলছিল তখন তিনি খসড়াটি দেখিয়েছিলেন সেনাপ্রধানকে। সেনাপ্রধান খসড়াটি দেখে বলেছিলেন ভাষণটি খুব ভালো হয়েছে। মুচকি হেসে মুশতাক বলেছিল, আপনার কি ধারণা ভাষণটি কয়েকদিন আগে লেখা হয়েছে? [সূত্র: হু কিলড মুজিব/ এ. এল. খতিব]। মানে হচ্ছে, এই ভাষণটি অনেক আগেই লেখা হয়েছে। যে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে, এই ভাষণের খসড়াটি কবে থেকে লেখা শুরু হয়েছে? কারণ, ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে তখন থেকেই।

দ্বিতীয় সূত্র: ১৯৭৫ সালের মে বা জুনের প্রথম দিকে ঢাকার গাজিপুর সালনা হাই স্কুলে ঢাকা বিভাগিয় স্বনির্ভর সম্মেলনে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা খন্দকার মুশতাকের সাথে দেখা করেন। এ সময় মুশতাক তাদের জিজ্ঞাসা করেন পরিকল্পনা কেমন চলছে? জবাবে সেনা কর্মকর্তারা বলেন, আমরা ঠিক আছি, ‘বস’ সব পরিকল্পনা করছে। যে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে, এই ‘বস’টি কে? কারণ, দূরবর্তী অবস্থানে নিরাপদে থেকে এই ‘বস’ সব কলকাঠি নেড়েছে, সকল সুবিধা ভোগ করেছে। এই ‘বস’ এর স্ত্রী পুত্ররাও এই সুবিধা ভোগ করে চলেছেন।

এই দুই প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধানেই পাওয়া যাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার কুশীলবদের ভয়াবহ চেহারা। বেরিয়ে আসবে নতুন অনেক চরিত্র এবং তাদের তৎপরতা। এদের মধ্যে বেসামরিক, রাজনীতিক এবং বিদেশী কূটনীতিকরাও ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে: হত্যার ক্ষেত্রে আসামীদের ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই, যড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণে দণ্ডবিধি অনুযায়ী ঘটনাস্থলে আসামীর উপস্থিতি প্রমাণেরও দরকার নেই। দূর থেকে হুকুম দিয়েও কাজ করা যায়। খুনী, পরিকল্পনাকারী, ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী, দূর থেকে মদতদাতা এদের সবার অভিন্ন ইচ্ছার মিল থাকলেই ষড়যন্ত্র সফল হয়। তারা সবাই একই দোষে দোষী।

বর্তমানের দায়িত্ব হচ্ছে, এই নেপথ্য কুশীলবদের চিহ্নিত করে তাদের দায় নিরূপণ করা। এই দায়িত্ব ইতিহাস অর্পিত। এই দায় এড়িয়ে গেলে ভবিষ্যৎ আমাদের ক্ষমা করবে না।

লেখক পরিচিতি: গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

ইতিহাসের দায় টপ নিউজ বঙ্গবন্ধু হত্যা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

২৪ বলে ০ রানে জাকিরের লজ্জার রেকর্ড
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:১৮

সম্পর্কিত খবর