পাহাড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৭১ হাজার কৃষক, ৮০% বান্দরবানের
১৫ আগস্ট ২০২৩ ২২:০২
রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নের কৃষক সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা। সবজি চাষ করেন নিজের জমিতে। সপ্তাহ ধরে টানা ভারী বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট বন্যায় তার সেই সবজি ক্ষেত বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ক্ষেতের ফসল।
সুশান্ত সারাবাংলাকে বলেন, এক সপ্তাহের বৃষ্টির কারণে হঠাৎ করেই কাপ্তাই হ্রদের পানি অনেক বেড়ে যায়। এতে কাপ্তাই হ্রদের নিচু এলাকায় আমার যে সবজি বাগান ছিল, সেটি পুরোটাই পানির নিচে তলিয়ে গেছে। কোনো ফসলই রক্ষা করতে পারেনি। হঠাৎ হ্রদের পানি বাড়লে কেবল আমি নেই, অসংখ্য কৃষক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
সুশান্তের মতো তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের আরও অনেক প্রান্তিক কৃষকই এবারের বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত এমন কৃষকের সংখ্যা ৭১ হাজার ২৫০ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বান্দরবানের কৃষকরা। তাদের সংখ্যা ৫৬ হাজার ২৫০ জন। এই সংখ্যা ক্ষতিগ্রস্ত মোট কৃষকের পাঁচ ভাগের চার ভাগ, সুনির্দিষ্টভাবে ৭৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
রাঙ্গামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে তিন পার্বত্য জেলায় এক লাখ ১৩ হাজার ৫১ হেক্টর কৃষিজমিতে আউশ ও রোপা আমন ধান এবং গ্রীষ্মকালীন সবজি, আদা, হলুদ, কলা, পেঁপেসহ অন্যান্য ফসলের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে তিন পার্বত্য জেলার ১৫ হাজার ৮২৭ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১২ হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমির ফসল। আবাদ হিসাবে ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর তিন জেলার ৭১ হাজার ২৫০ জন কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ ৩৮৩ কোটি ৮ লাখ টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যে জেলাভিত্তিক ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাঙ্গামাটি জেলায় ৫৯ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমির মধ্যে চার হাজার ৬২৮ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তিন হাজার ২১৪ হেক্টর জমির ফসল। ক্ষতির হার ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত দুই হাজার ৬৪১ হেক্টর ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত এক হাজার ৯৮৯ হেক্টর জমির ফসল। জেলার ১২ হাজার ১৬০ জন কৃষকের আর্থিক ক্ষতি ৬১ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
খাগড়াছড়ি জেলায় ৩২ হাজার ৭৯২ হেক্টর জমির মধ্যে এক হাজার ৩৪৪ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত ও ৭১০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শতকরা ক্ষতির হার ২ দশমিক ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ৭১০ হেক্টর ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ৬৩৪ হেক্টর জমির ফসল। জেলার দুই হাজার ৮৪০ জন কৃষক ১১ কোটি ২ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তিন জেলার মধ্যে এই জেলায় কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে কম।
অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বান্দরবান জেলায় ২০ হাজার ৪২৪ হেক্টর জমির মধ্যে ৯ হাজার ৮৫৫ হেক্টর জমির ফসলই আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আট হাজার ৮৫৩ হেক্টর জমির ফসল। ক্ষতির হার ৪৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ছয় হাজার ৩৭৪ হেক্টর, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত তিন হাজার ৪৮১ হেক্টর জমির ফসল। জেলার ৫৬ হাজার ২৫০ জন কৃষকের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩১০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির জেলার সব উপজেলা ক্ষতি হলেও খাগড়াছড়ির সদর, দীঘিনালা, মহালছড়ি ও রামগড় উপজেলার কৃষিজমি ক্ষতির মুখে পড়েছে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, গত কয়েক দশকের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিশেষত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় কাপ্তাই হ্রদের পানি বাড়লে জমির ফসল তলিয়ে গেছে। মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, ঢলের পানি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগেও তিন পার্বত্য জেলায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে। তবে এবারের মতো ক্ষয়ক্ষতির মুখে কখনোই পড়েননি পাহাড়ের কৃষকরা। কৃষকদের এই ভয়াবহ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের প্রণোদনা দরকার।
রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ৩ নম্বর ফারুয়া ইউনিয়নটি বেশ দুর্গম। এই ইউনিয়নের ৯০ শতাংশ মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি। এবারের বন্যায় প্রান্তিক সেই কৃষকরাই ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
ফারুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মৃনাল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবারের বন্যায় ফারুয়ার প্রান্তিক মানুষের যে ক্ষতি, তা সহজে কাটিয়ে ওঠার মতো না। পানিতে বাড়ি-ঘর ডুবে গেছে। ইউনিয়নের মূল বাজারে প্রায় অর্ধেক দোকান ভেঙে গেছে। নিচু এলাকা, বিশেষ করে জলে ভাসা জমিতে যেসব ফসলের আবাদ হয়েছে তার সবই এখন পানিতে তলিয়ে আছে। এ ছাড়া পুকুর ও মাছের ঘের বন্যার পানিতে ডুবে মৎস্য খাতেও ক্ষতি হয়েছে। কলা বাগান, পেঁপে বাগানসহ অন্যান্য ফলমূলের বাগানের ক্ষতিও ব্যাপক।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বান্দরবানের উপপরিচালক এম এম শাহ্ নেয়াজ বলেন, ‘টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় বান্দরবানে কৃষির ক্ষতি প্রায় ৩১০ কোটি ৭৩ লাখ টাকার। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে লামা, সদর উপজেলা, আলীকদম ও রোয়াংছড়িতে। আমরা মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানিয়েছি। আশা করছি শিগগিরই ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে বান্দরান পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কিছু আমন বীজ দেয়া হবে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাঙ্গামাটি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক তপন কুমার পাল সারাবাংলাকে বলেন, তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বান্দরবানে। এই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা আসলেই কঠিন। আমরা খামারবাড়িতে (কৃষি বিভাগের প্রধান কার্যালয়) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে চলতি আমন মৌসুমে বিভিন্ন জাতের বীজের চাহিদা দিয়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত জেলার চাহিদা ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরামর্শ নিয়ে চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে।
কৃষকদের কিছু আমন বীজ সরবরাহ করা গেলে তারা কিছুটা হলেও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে মনে করছেন তপন কুমার পাল।
সারাবাংলা/টিআর
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষিতে ক্ষতি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বন্যা পার্বিত্য তিন জেলা বান্দরবান রাঙ্গামাটি