রাস্তাঘাট উন্নয়নে পরামর্শকেই যাবে ৩১৬ কোটি টাকা
১৮ আগস্ট ২০২৩ ১১:৪২
ঢাকা: দেশের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর রাস্তাসহ বিভিন্ন অবতকাঠামো উন্নয়নে পরামর্শক খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ৩১৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা। যেটি মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এটাসহ আরও নানা খাতের ব্যয়ের প্রস্তাব প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ফলে গত ১০ আগস্ট অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এসব ব্যয় প্রস্তাবের চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ব্যয় যুক্তিযুক্ত করতে গঠন করা হয়েছে কমিটি। ‘রিজিলিয়েন্ট আরবান অ্যান্ড টেরিটরিয়াল ডেভেলপমেন্ট (আরইউটিডি)’ শীর্ষক প্রকল্পে এমন ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছিল।
পরিকল্পনা কমিশন বলেছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) সাধারণত পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের সড়ক ব্রিজ, ফুটপাত, ড্রেন নির্মাণ, স্ট্রিট লাইট স্থাপন কাজগুলো করে থাকে। সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রস্তাবিত প্রকল্পের কাজগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। তাই এতো সংখ্যক বিদেশি-দেশি পরামর্শক প্রস্তাব ও খাতের ব্যয় কমানো প্রয়োজন।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯৪১ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১ হাজার ৬৮১ কোটি ৬২ লাখ এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ থেকে ৪ হাজার ২৫৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২৯ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অদিদফতর।
পরিকল্পনা কমিশনের মতামত: পিইসি সভার কার্যপত্রে পরিকল্পনা কমিশন বলেছে মিউনিসিপ্যাল গভর্নেন্স এন্ড সার্ভিসেস প্রজেক্ট (এমজিএসপি) দ্বিতীয় সংশোধিত প্রকল্পটি গত বছরের জুনে সমাপ্ত হয়েছে। সেটির ধারাবাহিকতায় এ প্রকল্পটি নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রস্তাবিত প্রকল্পের ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সমাপ্তি মূল্যায়ন প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তাছাড়া যেসব আউটপুট পাওয়া গেছে তার প্রতিফলন এবং আইএমইডির পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন।
সেখানে আরও বলা হয়, প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান করেছে তা স্পষ্ট নয়। সম্ভাব্যতা যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের সিল ও সই ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এছাড়া সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে মিউনিসিপ্যাল গভর্নেন্স এন্ড সার্ভিসেস প্রজেক্ট বিবেচনায় নিয়ে করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে সভায় আলোচনা করা যেতে পারে।
আউটসোর্সিং এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনার জনবল বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অর্থ বিভাগের জনবল কমিটির সুপারিশ ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত নেই। এ বিষয়ে কমিটির সুপারিশ নিয়ে তা পুনর্গঠিত ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়া গাড়ি ক্রয়ের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের সুপারিশ ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত নেই, যা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। প্রকল্পের আওতায় গাড়ি ক্রয়ের যৌক্তিকতা নিয়েও ব্যাখা প্রয়োজন বলেও মত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্পের আওতায় ২ দশমিক ৫০ একর ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ১০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু ভূমির প্রাপ্যতা এবং ভূমির মূল্য নির্ধারণের ভিত্তি হিসাবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রাক্কলন ও প্রত্যয়ন ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত নেই। ডিপিপিতে পুনর্বাসন বাবদ ৫০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। কোন কোন এলাকায় এই পুনর্বাসন করা হবে, কোন পদ্ধতিতে করা হবে এবং কারা ক্ষতিপূরণ পাবে তার একক, পরিমাণ ও টাকাসহ তালিকা টেবিল আকারে ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। অফিস সরঞ্জাদি ক্রয় ৪০০ সেট কম্পিউটার বাবদ ৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ২০টি ল্যাপটপ বাবদ ৪০ লাখ টাকা, ১৮টি মাল্টি ফাংশন প্রিন্টার বাবদ ১৮ লাখ টাকা, ১০০টি ফটোকপিয়ার বাবদ ২ কোটি টাকা, ১২টি প্রজেক্টর ক্রয় বাবদ ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি ক্রয়ের যৌক্তিকতা জানতে চাওয়া হয়।
এলজিইডির দক্ষতা উন্নয়নের জন্য ৩৯০ সেট কম্পিউটার বাবদ ৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা, একটি মাল্টি ফাংশন প্রিন্টিার বাবদ এক লাখ টাকা, একটি ফটোকপিয়ার বাবদ ৩ লাখ টাকা, ফার্নিচার বাবদ ৮০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় ৮০টি পৌরসভা এবং ৫টি সিটি করপোরেশন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনগুলো নির্বাচনের পদ্ধতি বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
কমিশন তার মতে আরও জানায়, প্রকল্পের আওতায় বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বাবদ ৫ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের কার্যক্রম গুলো হলো- সড়ক, ব্রিজ বা কালভার্ট, ফুটপাত, ড্রেন নির্মাণ, স্ট্রিট লাইট স্থাপন ও পার্ক নির্মাণ ইত্যাদি। এসব কার্যক্রম এলজিইডি বাস্তবায়ন করে থাকে। তাই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বৈদেশিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নেই। এ কারণে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ অঙ্গটি ডিপিপি হতে বাদ দেওয়া যেতে পারে। অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ বাবদ প্রায় ২০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব প্রশিক্ষণ কাদের দেওয়া হবে এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সভায় আলোচনা করা যেতে পারে।
রাজস্ব খাতে বিজ্ঞাপন বাবদ ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা, এন্টারটেইনমেন্ট বাবদ ৫৪ লাখ টাকা, বিদ্যুৎ বাবদ এক কোটি টাকা, কুরিয়ার বাবদ ৩৬ লাখ টাকা, ইন্টারনেট বাবদ ৩৬ লাখ টাকা এবং অডিও ভিডিও বাবদ ৪৩ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এ সকল ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে সভায় আলোচনা করা যেতে পারে। খুব প্রয়োজন না হলে এন্টারটেইনমেন্ট, বিদ্যুৎ অঙ্গ দুটি বাদ দেওয়া পারে। এছাড়া বিজ্ঞাপন কুরিয়ার, ইন্টারনেট, অডিও ভিডিও খাতের প্রস্তাবিত ব্যয় যৌক্তিকভাবে হ্রাস করা যেতে পারে। পেট্রোল ওয়েল এবং লুব্রিক্যান্ট বাবদ ১৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা, গ্যাস ও ফুয়েল বাবদ ৩ কোটি ১৬ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে সভায় আলোচনা করা যেতে পারে মত দেয় কমিশন।
ট্রাভেল এক্সপেন্স খাতে ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অত্যধিক বলে মনে হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত বিশ্বব্যাংক ৪ হাজার ২৫৯ কোটি ৬০ লাখ টাকার ঋণ দেবে। এ ঋণের বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সভায় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে পারেন বলেও মতামত দেয় পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্পটির প্রস্তাবনায় বলা হয়, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ও ঘনবসতি পূর্ণ দেশ। দেশের ১৬ কোটি ৯৪ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ শহরাঞ্চলে বাস করে। গত দুই দশকে উন্নতভাবে বসবাসের জন্য গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। শহরে বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য নগর পরিষেবাগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বর্তমানে নগরের জনসংখ্যা ১৯৭১ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ৮ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮ দশমিক ৯৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে নগরের জনসংখ্যা ৩৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ হলে ও জিডিপিতে তাদের অবদান ৬০ শতাংশের বেশি। নগর এলাকায় শ্রমের উৎপাদনশীলতা গ্রামীণ এলাকার তুলনায় অনেক বেশি।
বর্তমানে দ্রুত নগরায়নের ফলে দেশের শহর ও নগরগুলো অবকাঠামো এবং সেবা দেওয়ার ফলে নগরগুলো সমস্যায় পড়ে। ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামোগুলোর অবস্থা ভাল নয়। তাই নগরে সেবা দেওয়া প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নগর উন্নয়ন সূচক অদক্ষ হয়ে পড়েছে। উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও নগর সম্প্রসারণের ফলে প্রাকৃতিক ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলোতে নগর পরিষেবা এবং অবকাঠামোর ঘাটতি মধ্যে ব্যবধান ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ একটি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান নেতিবাচক প্রভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষ বিশেষ করে দরিদ্র ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী স্থানান্তরিত হচ্ছে এবং খরার কারণে কৃষি কাজ করা ক্রমাগত অসম্ভব হয়ে পড়ছে। দেশে জলবায়ুগুলোতে আরও অনেক ঝুঁকির মাত্রা রয়েছে। দেশের প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র নিরসনের ক্ষেত্রে নগর সুশাসন প্রতিষ্ঠা একটি মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বিবেচনায় প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদান উলাহ মিয়ান সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরামর্শকের প্রয়োজন আছে। কেননা দেশের সব সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। সেখানে পর্যাপ্ত লোকবল নেই। মানসম্পন্নভাবে কাজগুলো করতে হলে পরামর্শকের প্রয়োজন হবে। তবে কত টাকা লাগবে সেটি আলোচনা করা হয়েছে। এ খাতেসহ অন্যান্য আরও অনেক খাতের ব্যয় পর্যালোচনা করে দেখতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি প্রতিবেদন দিলে তারপরই প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে।’
সারাবাংলা/জেজে/এনএস