Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘জোটসঙ্গী’র রাজনীতিতে আটকে রওশন-কাদেরের দ্বন্দ্ব অবসান

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৯ আগস্ট ২০২৩ ২১:০০

ঢাকা: আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত কাছে আসছে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক নাটকও ততই ঘণীভূত হয়ে পরিণতির দিকে যাচ্ছে। সূত্র বলছে, এরশাদের ছোট ভাই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক এরশাদপত্নী বেগম রওশনের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্বের অবসান অনেক দূর এগিয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে একটি অদৃশ্য রাজনৈতিক শক্তি কাজ করছে বলে দুই গ্রুপের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা ইঙ্গিত দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

উভয় গ্রুপের নেতারা জানান, দ্বন্দ্ব অবসানে বেগম রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের- দুজনেই রাজি আছেন। তবে বহিষ্কৃত নেতাদের পদে ফেরাতে রাজি হচ্ছেন না জিএম কাদের। এ ছাড়া জাপা চেয়ারম্যান বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধতে চাচ্ছেন। কিন্তু রওশন এরশাদ সরকারি দলের সঙ্গে নির্বাচনি জোটে যাওয়ার ঘোষণা অনেক আগেই দিয়ে রেখেছেন। ফলে দ্বন্দ্ব নিরসনের বিষয়টি এখানেই আটকে আছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই ও দ্বন্দ্ব শুরু হয়। রওশন চেয়েছিলেন জাপার চেয়ারম্যান হতে, কিন্তু পারেননি। এরশাদ অসুস্থ থাকাবস্থায় জিএম কাদের কৌশলে জাপা চেয়ারম্যানের পদটি ভাগিয়ে নেন। পরে দলের কাউন্সিলে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে তা পাসও করে নেন।

রওশনপন্থীদের অভিযোগ, সম্মেলনে নিজের অবস্থান শক্ত করতে গঠনতন্ত্র সংশোধন করেন জিএম কাদের। সেই গঠনতন্ত্রটি দিয়ে তিনি দলীয় প্রধানের পদে টিকে আছেন। আর দলে স্বৈরতান্ত্রিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য করেছেন আরেকটি গঠনতন্ত্র। অর্থাৎ দু’টি গঠনতন্ত্র দিয়ে দল পরিচালনা করছেন তিনি। ফলে বিষয়টি আদলত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এমনকি জিএম কাদেরের দল পরিচালনার ক্ষেত্রে আদালত নিষেধাজ্ঞাও জারি করেন।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, পরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে জিএম কাদের রওশন এরশাদসহ বহিষ্কৃত নেতাদের উপর ক্ষুব্ধ হন। তবে রওশন এরশাদ তার অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ায়নি। তিনি চাচ্ছেন দলের বহিষ্কৃত নেতাদের পার্টিতে অর্ন্তভুক্ত করাতে; যাতে সংবিধান অনুযায়ী তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। কিন্তু জিএম কাদের এই প্রস্তাব মেনে নিতে চাচ্ছেন না। সেইসঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবশে সৃষ্টি না হলে তিনি নির্বাচনে যেতে রাজি নন। ইতোমধ্যে তিনি এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই না। তবে অবাদ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সেজন্য যেসব দল আন্দোলনে রয়েছে আমরা তাদের দাবিকে সমর্থন করি।’

বিজ্ঞাপন

সূত্র জানায়, এর আগে জিএম কাদের বিএনপির মহসচিবের সঙ্গে বৈঠক করে তারেক রহমান দেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত তাকে (জিএম কাদের) প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদে ১০ জন সদস্য নেওয়ার প্রস্তাব দেন। এ নিয়ে জাপা ও বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যদিও ওই প্রস্তাবের পর বিএনপির পক্ষ থেকে তেমন কোনো ইঙ্গিত পাননি কাদের। তারপরও তিনি বিএনপি জোটের দিকে ঝুঁকে আছেন।

সূত্র আরও জানায়, জিএম কাদেরর গ্রুপে বিএনপি ঘেঁষা হাতে গোনা দুয়েকজন নেতা রয়েছেন। সম্প্রতি দলটির প্রেসিডিয়াম বৈঠকে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। ওই বৈঠকে ৩৯ জন প্রেসিডিয়াম সদস্যের মধ্যে ৩৭ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে ৩২ জনই দলের করুণ চিত্র তুলে ধরে বক্তব্য দেন। তাদের প্রায় প্রত্যেকের বক্তব্যে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে মত আসে।

বৈঠকে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু দলের পরিস্থিতি বর্ণনা করে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করলে দুয়েকটি আসন পেতে পারে। পার্টির রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে হলে এমপি হতে হবে।’ তিনি জাতীয় পার্টির উপর বিএনপির আচরণ ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদকে তারেক রহমানের করা অপমানের বর্ণনা তুলে ধরেন। ওই বৈঠকে জাপার কী করণীয় সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। জাপা কোন জোটে যাবে সেই সিদ্ধান্ত আগীম সেপ্টেম্বরে আসতে পারে বলে জানা গেছে।

এদিকে, বেগম রওশন এরশাদ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, তিনি সরকারি দলের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে যাবেন। এজন্য তিনি দলের কাউন্সিলের প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছেন। সূত্র মতে, জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্বের অবসান না হলে রওশন জাপার কাউন্সিল ডেকে দলের নেতৃত্ব ঠিক করবেন। তার সঙ্গে জাপার সাবেক ও বর্তমান এমপিরা রয়েছেন বলে দাবি রওশনপন্থীদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রওশন এরশাদ এখন অনেকটা সুস্থ। তিনি সম্প্রতি স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষ করে থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফিরেছেন। এমনকি দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। সেই সাক্ষাতে তিনি আওয়ামী লীগকে সবধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

জানা গেছে, জাপার সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দ্রুতই বৈঠকে বসবেন রওশন এরশাদ। যে বৈঠকে দলের সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে দলের বর্ধিত সভার দিন-তারিখ ঠিক করতে পারেন। এমনকি দলের কাউন্সিলের ব্যাপারেও বৈঠকে আলোচনা হতে পারে। এ প্রসঙ্গে রওশনপন্থী গ্রুপের শীর্ষ নেতা গোলাম মসীহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সমঝোতার জন্য আমাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। জিএম কাদের সাহেব আমাদের দলে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছেন। তবে পদ-পদবি নিয়ে তিনি গড়িমসি করছেন।’

একই গ্রুপের আরেক নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘চেয়ারম্যান আামদের দলে ফিরিয়ে নিতে রাজি। কিন্তু তিনি চাচ্ছেন, বিএনপির সঙ্গে গিয়ে জোট বাঁধতে; তাতে আমরা রাজি নই। কারণ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান এরশাদ সাহেবকে অপমান করেছেন। এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় থেকে দলটিতে আছি। কোনোদিন তার চোখে পানি দেখিনি। তারেক রহমান যেদিন তাকে অপমান করলেন সেদিন তার চোখে পানি দেখেছি। জিএম কাদের আমাদের সব দাবি মেনে না নিলে রওশন এরশাদ তার মতো করে নির্বাচনে অংশ নেবেন।’

এ সব বিষয় নিয়ে রওশন এরশাদ গ্রুপের আরেক নেতা ইকবাল হোসেন রাজু সারাবাংলাকে বলেন, ‘বেগম রওশন এরশাদ জাপাকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে এ নিয়ে প্রস্তাব এসেছে। তার পক্ষ থেকেও প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। রওশন এরশাদ চাচ্ছেন- দলের বহিষ্কৃত নেতাদের দলে ফেরাতে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, আসছে অক্টোবরের দিকে জাতীয় পার্টি এক হয়ে যাবে। কোনো কারণে যদি তা না হয় তবে বেগম রওশন এরশাদ দলের কাউন্সিল ডেকে নেতৃত্ব নিয়ে নেবেন। কারণ, তার সঙ্গে দলের সিনিয়র নেতারা রয়েছেন।’

এদিকে, জাপার এক প্রেসিডিয়াম মেম্বার (জিএম কাদের গ্রুপ) ও সংসদ সদস্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে আছি। তবে এই মুহূর্তে প্রকাশ্যে এলে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি। সেজন্য প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করছি না। বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে।’

জিএম কাদের গ্রুপের আরেক নেতা প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. জহিরুল আলম রুবেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির মধ্যে বিরাজমান সংকট থাকবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। বিষয়টি সময়ের ব্যাপারমাত্র।’

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিএম কাদের সংসদীয় দলের বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে সংসদ সদস্যদের মনোনয়নের ভয় দেখিয়ে সমর্থন নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা হয়ে একটি চিঠি দেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে। এর পর একই বছরের ২৬ নভেম্বর জাতীয় পার্টির (জাপা) কাউন্সিল ডাকেন রওশন এরশাদ। কাউন্সিল সফল করতে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ কো-চেয়ারম্যানদের যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। আর প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হয়েছিলেন রওশন এরশাদ নিজেই। এভাবেই দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে, যা এখনও চলমান।

সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম

জাতীয় পার্টি জিএম কাদের দ্বন্দ্ব দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন রওশন এরশাদ

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর