গ্রেনেড হামলা: ভয়াল সেই ৪৫ সেকেন্ড
২১ আগস্ট ২০২৩ ০৯:১৭
রাজনীতির ইতিহাসে এক ঘৃণ্য হামলা। লক্ষ্য ছিল বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। প্রকাশ্য জনসভায় তাই ছুড়ে দেওয়া হয় গ্রেনেড। চালানো হয় গুলি। জনসভার ময়দান পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তখন নারকীয় পরিস্থিতি। মামলার নথিপত্রের বিবরণে উঠে এসেছে, প্রায় ৪৫ সেকেন্ড ধরে চালানো হয় সেই হামলা, যা এক কালো অধ্যায় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতয়।
১৯ বছর আগে ২০০৪ সালে আজকের এই দিন তথা ২১ আগস্টে পৃথিবী সাক্ষী হয়েছিল এক নৃশংস হামলার। একুশে আগস্টের সেই হামলার লক্ষ্য ছিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনিসহ দলের শীর্ষ নেতাদের হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যেই চালানো হয় হামলা। পরবর্তী সময়ে তথ্য-প্রমাণে বেরিয়ে আসে, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদত ও কোনো কোনো পর্যায়ের সহায়তাতেই বাস্তবায়ন করা হয় এই হামলা। অথচ আওয়ামী লীগ সেই সমাবেশ আয়োজনই করেছিল সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশ হিসেবে।
ভয়াবহ সেই হামলার দিনই প্রাণ হারান ১৬ জন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় আরও আটজনের। এর সঙ্গে আহত হন আওয়ামী লীগের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। সেদিনের জনসভায় বক্তৃতার মঞ্চ ছিল ট্রাকের ওপর। সেই ট্রাককে লক্ষ্য করে আটটি আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হলেও ট্রাকে থাকা নেতাদের মানবঢাল সুরক্ষা দেয় শেখ হাসিনাকে। কোনোমতে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। তবে হারিয়ে ফেলেন শ্রবণশক্তি, যার ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
সেই হামলার তদন্ত ও আইনি কার্যক্রম থেকে জানা যায়, সেনা ও বিমান বাহিনীর সাবেক দুই কর্মকর্তা মেজর (অব.) শোয়েইব মো. তরিকুল্লাহ্ ও স্কোয়াড্রন লিডার (অব.) আব্দুল্লাহ্ আল মামুন সেদিন শেখ হাসিনাকে ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদে নিয়ে যান। তারা দুজনেই এলিট স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) সাবেক সদস্য। সুরক্ষা দিতে তারা বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন।
মামলার নথিপত্রসহ তদন্তের বিভিন্ন কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিকেল ৫টা ১৮ মিনিটে শুরু হয় বর্বরোচিত সেই হামলা। চালানো হয় প্রায় ৪৫ সেকেন্ড ধরে। হামলাকারীরা একে একে আটটি আর্জেস গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায়। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তখন সেই ট্রাকের ওপর, যেটি ব্যবহার করা হচ্ছিল জনসভার অস্থায়ী মঞ্চ হিসেবে। অবসরপ্রাপ্ত ওই দুই সামরিক কর্মকর্তাও ছিলেন সেই ট্রাকে। গ্রেনেড হামলার তদন্তে উঠে এসেছে সেই হামলার ৪৫ সেকেন্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা। সেই বর্ণনা দেখে নেয়া যাক-
– বিকেল ৫টা ১৮ মিনিট: শেখ হাসিনা জনসভার সভাপতির ভাষণ শেষ করে ট্রাক থেকে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় আতোতায়ীরা প্রথম গ্রেনেডটি ছুড়ে মারে। সেই গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলে ট্রাক ও ট্রাকের আশপাশের মানুষ আতঙ্কে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ের।
– দলীয় নেতারা ট্রাকের সামনের দিকে শেখ হাসিনাকে ঘিরে মানবঢাল তৈরি করে তাকে রক্ষার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় গ্রেনেডটি ট্রাকের সবাইকে বসে পড়তে বাধ্য করে। এ সময় শেখ হাসিনাকে রক্ষার জন্য স্কোয়াড্রন লিডার মামুন তাকে টেনে ট্রাকে রাখা একটি ছোট টেবিলের নিচে ঢুকিয়ে দেন এবং নিচু করে রাখেন।
– মেজর শোয়েইব চিৎকার করে মামুনকে বলেন, শেখ হাসিনাকে যেন নিচু করা হয়। পরিস্থিতি বুঝতে কয়েকবার বাঁশের সিড়ি বেয়ে ট্রাকে ওঠানামা করেন। পাশের ভবনগুলোর ছাদ থেকে গ্রেনেড ছোড়া হচ্ছিল।
– সপ্তম গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত হামলাকারীরা একের পর এক গ্রেনেড ছুড়ছিল। এ সময় মামুনকে চিৎকার করে শোয়েইব বলেন, ‘আপাকে (শেখ হাসিনা) বের করে আনো।’
– মামুন নিচু থেকেই শেখ হাসিনাকে টেবিলের নিচ থেকে বের করেন। চিৎকার করে শোয়েইবকে বলেন, ‘জিপের দরজা খোলো।’
– শেখ হাসিনাকে ট্রাকের সিঁড়ির কাছে নেন মামুন। মেজর শোয়েইব তখন সিঁড়ির মাঝামাঝি অবস্থান করছিলেন। শেখ হাসিনাকে ট্রাকে দেখতে পেয়ে হামলাকারীরা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে রমনা ভবন থেকে অষ্টম গ্রেনেডটি ছুড়ে মারে। গ্রেনেডটি ঘুরতে ঘুরতে বিস্ফোরিত হয় এবং জ্বালানি ট্যাংকে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার ঢুকলে সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে তেল পড়তে থাকে।
– মামুন আবারও শেখ হাসিনাকে ট্রাকের নিচে রাখেন। কয়েক মুহূর্ত পর শোয়েইব ট্রাক থেকে নিচে নেমে জিপের দরজা খোলেন এবং ট্রাকের সিঁড়ির কাছে চলে যান। শেখ হাসিনাকে সেখানে নিয়ে যান মামুন। তারা দুজন মিলে দ্রুত শেখ হাসিনাকে জিপে ঢুকিয়ে দেন।
৫টা ১৯ মিনিট: শেখ হাসিনা জিপে ওঠামাত্র সেটি ধানমন্ডিতে শেখ হাসিনার তখনকার বাসভবন সুধা সদনের পথে রওনা দেয়।
নারকীয় এই হামলায় অস্থায়ী মঞ্চ ট্রাকে থাকা দলের নেতাদের তৈরি মানবঢালের কারণে প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। দুই নিরাপত্তা কর্মকর্তার দক্ষতায় সেখান থেকে নিরাপদেই পৌঁছে যান নিজ বাসভবনে। তবে শ্রবণশক্তিতে গভীর ক্ষত তৈরি হয় তার, যা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। অন্যদিকে তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা মেজর শোয়েইব ও স্কোয়াড্রন লিডার মামুন দুজনেই স্প্লিন্টারবিদ্ধ হন। বাসস
সারাবাংলা/টিআর