২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা: চলতি বছরই আপিল নিষ্পত্তির আশা
২১ আগস্ট ২০২৩ ১০:০১
ঢাকা: আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর ১৯ বছর পার হতে চললেও এখন পর্যন্ত মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। যে কারণে রায় কার্যকর করা যাচ্ছে না। যদিও অধস্তন আদালত ২০১৮ সালে এ মামলায় ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন। এরপর মামলার ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের আপিল ও জেল আপিল করলে তা শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হয়।
গত বছরের ৫ ডিসেম্বর এই হামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শুরু হয়েছে। তবে এখনও রাষ্ট্রপক্ষের পেপারবুক পড়া শেষ হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের আশা চলতি বছরই হাইকোর্ট এ মামলা নিষ্পত্তি করবেন।
আইনমন্ত্রীও একই ধরনের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। গতকাল (২০ আগস্ট) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী চলতি বছরেই হাইকোর্টে এই মামলা নিষ্পত্তির আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি সবাইকে এটুকু আশ্বস্ত করতে পারি যে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলার পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার জোর চেষ্টা চলছে এবং এই চেষ্টাও অব্যাহত থাকবে। আমি আশা করছি এ বছরের মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলার বিচার শেষ হবে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘এই মামলার পেপারবুক পড়া প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। যে বেঞ্চে এই মামলা চলছে সেই বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি অসুস্থ থাকায় আপাতত বেঞ্চ বসছেন না। আশা করি বিচারপতি সুস্থ হলেই বেঞ্চে বসবেন। বেঞ্চ বসলেই আমরা শুনানি শেষ করব। শুনানি শুরু হলে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদের যুক্তিতর্ক তুলে ধরবেন। পরে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরব।‘
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা বিচারিক আদালতের রায় হাইকোর্টেও বহাল থাকবে। আদালতের কাছে এই মামলার আসামি তারেক রহমানসহ সব আসামির রায় বহাল রাখার জন্য আবেদন জানাব।’ আগামী অক্টোবর মাসের মধ্যে এই মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষ হওয়ার প্রত্যাশা করছেন তিনি।
আসামি পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের পেপারবুক পড়া এখনও শেষ হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের পেপারবুক পড়া শেষ হলে আমরা আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করা হবে।’
২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল, জেল আপিল শুনানি শুরু হয়।
বর্তমানে বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে।
২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল, জেল আপিল শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন প্রধান বিচারপতি।
এ মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর অধস্তন আদালত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন। একইসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয় অপর ১১ আসামিকে। পরে ওই বছরের ২৭ নভেম্বর মামলার বিচারিক আদালতের রায় প্রয়োজনীয় নথিসহ হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পৌঁছায়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হামলায় আইভি রহমানসহ নিহত হন ২৪ জন।
ওই হামলায় ২০১৮ সালে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। পরে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিলের শুনানি শুরু হয়।
গত ৫ ডিসেম্বর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আপিল শুনানি শুরু হয়।
গত বছরের ১৬ আগস্ট পেপারবুক বিজি প্রেস থেকে তৈরির পর সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছায়। বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— লুৎফুজ্জামান বাবর, আব্দুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির আহ্বায়ক মাওলানা শেখ আবদুস সালাম (কারাগারে মারা যান), কাশ্মীরি জঙ্গি আব্দুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. উজ্জ্বল, এনএসআই’র সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম (কারাগারে মারা যান) ও হানিফ পরিবহনের মালিক বিএনপি নেতা মোহাম্মদ হানিফ।
পরিকল্পনা ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করার অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেন আদালত।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন— তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ (কারাগারে মারা যান), মাওলানা সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম মাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল ওরফে ইকবাল হোসেন, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু।
তাদের দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হক, বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ডিজিএফআই’র মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, ডিএমপির সাবেক উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, আরেক সাবেক উপ-কমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মো. রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেন আদালত।
নথিপত্র অনুযায়ী, তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৬ জন পলাতক। তবে হারিছ চৌধুরীর মেয়ে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সামিরা চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তার বাবা ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। ভিন্ন পরিচয়ে এত বছর তিনি ঢাকাতেই ছিলেন।
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেনি।
সারাবাংলা/কেআইএফ/এমও