‘অমানুষ তৈরির কারখানা’ হয়ে উঠেছে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র
২৪ আগস্ট ২০২৩ ১৩:১০
যশোর: শারীরিক-মানসিক কোনো উন্নয়নেরই পরিবেশ নেই যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে। সরকার-নিয়ন্ত্রিত সমাজসেবা অধিদফতরের অধীন এই কেন্দ্রটিতে (বালক) ১৫০টি থাকার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেখানে থাকছে ৩১৯ জন। নেই তাদের ঘুমানোর জায়গা। বরাদ্দের অভাবে পেটপুরে খাওয়া হচ্ছে না। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোনো সুযোগও পাচ্ছে না শিশুরা। এসব কারণে সংশোধনের পরিবর্তে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা হিংস্র হয়ে উঠছে। প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে আইনভঙ্গের ঘটনা। স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বলছেন, শিশুদের সংশোধনের পরিবর্তে এই কেন্দ্রটি অমানুষ তৈরির কারখানা হয়ে উঠেছে।
যশোরের পুলেরহাটে পাঁচ দশমিক ২২ একর জমিতে ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এ সংশোধানাগার। তবে কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। বিভিন্ন কারণে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাওয়া অপ্রাপ্তবয়স্ক বালকদের প্রচলিত জেলখানায় অপরাধীদের সঙ্গে রাখার পরিবর্তে সংশোধনের জন্যে এই কেন্দ্রটি ব্যবহার করা হয়। শাস্তি নয়, সংশোধনের জন্যই এই প্রতিষ্ঠান। খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ৩২টি জেলার ২২০টি উপজেলা থেকে শিশুরা আসে এই প্রতিষ্ঠানে।
আদালত যে শিশুদের বিশেষ ব্যবস্থায় রেখে সংশোধনের নির্দেশ দেন, তারাই থাকে এ কেন্দ্রে। এখানে থাকার সর্বোচ্চ বয়সসীমা ১৮ বছর। এরপরও তাদের অন্তরীণ রাখার প্রয়োজন বোধ করলে আদালত কারাগারে পাঠাতে পারেন বা জামিন দিতে পারেন কিংবা সাজার মেয়াদ শেষ হলে মুক্তি দিতে পারেন।
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানের আসনক্ষমতা বা ধারণক্ষমতা ১৫০ হলেও বর্তমানে সেখানে ৩১৯টি শিশু থাকছে। কখনো কখনো এই সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়ে যায়। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুমোদিত জনবলের জন্য পদ রয়েছে ৪৯টি। অথচ বর্তমানে সেখানে কর্মরত মাত্র ২৪ জন। ২৫টি তথা অর্ধেকেরও বেশি পদ শূন্য পড়ে রয়েছে। ফলে কাজকর্মে হচ্ছে নানা অসুবিধা। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি শিশু অথচ জনবল অর্ধেকের কম হওয়ায় নিবিড় তত্ত্বাবধান হচ্ছে না এবং গাদাগাদি করে একই ফ্লোরে বিভিন্ন শ্রেণির অপরাধে জড়িতদের একসঙ্গে রাখতে হচ্ছে বলেও স্বীকার করছে কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, এখানকার প্রতিটি শিশুর খাবারের জন্য দৈনিক বরাদ্দ ১০০ টাকা। তবে ভ্যাট, ট্যাক্স ও ঠিকাদারের লভ্যাংশ কেটে দৈনিক সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ পাওয়া যায় একেকটি শিশুর জন্য। এই টাকাতেই সকালের নাশতা, দুপুর ও রাতের খাবার এবং বিকেলের নাশতার ব্যবস্থা করতে হয়। আবার বিশেষ বা জাতীয় দিবসে উন্নত খাবার পরিবেশনের জন্য বাড়তি বরাদ্দ না থাকায় ওই বাজেট থেকেই টাকা কেটে রাখা হয় উন্নত খাবার দেওয়ার জন্য। ফলে শিশুদের প্রতিদিনের খাবারের বরাদ্দ আরও কমে আসে। তাতে একবেলা কোনোমতে মাছ-মাংসের ব্যবস্থা করা গেলেও অন্য বেলাগুলোতে ডাল-সবজি ছাড়া আর কিছু করার সুযোগ থাকে না।
নীলফামারি থেকে আসা এক শিশুর বাবা মোবারক হোসেন বলেন, ‘হোটেলে একটা রুটির দাম দিতে হয় ১০ টাকা, যেকোনো ধরনের মাংস ৮৫ থেকে ১১০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। সেখানে ৮০-৮৫ টাকায় একজন শিশুর চার বেলার খাবার কীভাবে হয়?’
খাবারের জন্যে এত কম বরাদ্দ নিয়ে চলতি মাসে জেলা প্রশাসনের একটি সভাতেও ক্ষোভ জানিয়েছেন সদস্যরা। এ বিষয়ে একাধিকবার সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে সমাজসেবা যশোর অফিস।
তথ্য মতে, যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের একজন শিশুর জন্যে মাসে মাত্র চার হাজার টাকা বরাদ্দ থাকে। এই টাকা থেকে খাদ্য ও জ্বালানি বাবদ তিন হাজার টাকা, শিক্ষায় ৩৫০ টাকা, প্রশিক্ষণে ১০০ টাকা, পোশাক পরিচ্ছদে ৩০০ টাকা, চিকিৎসায় ১০০ টাকা এবং তেল-সাবান ও আনুষঙ্গিক খরচ হিসেবে ১৫০ টাকা ব্যয় করার কথা। তবে প্রতি ক্ষেত্রেই ভ্যাট, ট্যাক্স, পরিবহন, ঠিকাদারের লভ্যাংশও এর মধ্যে থেকে রাখতে হয়।
প্রতিষ্ঠানে থাকা শিশুদের একটি বড় অংশের শিক্ষার ব্যবস্থাও নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, এখানে ১২ বছরের নিচে অর্থাৎ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে মাত্র দুটি শিশু রয়েছে যাদের বয়স ১২ বছরের কম। বাকি তিন শতাধিক শিশু মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়ার উপযুক্ত হলেও তাদের পড়ালেখার কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই।
চলতি মাসের তথ্য অনুযায়ী, এই কেন্দ্রে এখন ৯ থেকে ১২ বছরের শিশু দুজন, ১২ থেকে ১৬ বছরের ১২০ জন, ১৬ থেকে ১৮ বছরের ৯৭ জন এবং ১৮ বছরের বেশি বয়সী ২২ জন রয়েছে। এর বাইরে ৭৮ জনের বয়স উল্লেখ নেই। বিভিন্ন বয়সের শিশুদের একসঙ্গেই রাখা হয় এই কেন্দ্রে।
এদিকে অপরাধের ধরন অনুযায়ী যশোরের এই কেন্দ্রে হত্যা মামলায় ৮৫ জন, নারী ও শিশু নির্যাতন তথা ধর্ষণ মামলার আসামি ৯৭ জন, দ্রুত বিচার আইনে দুজন, অপহরণ মামলায় ৯ জন, মাদকদ্রব্য আইনে ২৬ জন, অস্ত্র আইনে একজন, বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুজন, প্রযুক্তি আইনে দুজন, চুরির ঘটনায় ৩২ জন, নিরাপদ হেফাজতে পাঁচজন এবং অন্যান্য মামলার ৫৪ জন আসামি রয়েছে। বিচার শেষে সাজাপ্রাপ্ত আসামি রয়েছে চারজন।
কেন্দ্রের কর্মকর্তারাই বলছেন, প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় দায়িত্বপ্রাপ্তরা ইচ্ছা করলেও সম্পূর্ণরূপে ও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় রাতে। শিশুদের প্রতি ফ্লোরে যে ওয়ার্ডার থাকার কথা, জনবলের অভাবে সেটি নেই। ফলে রাতে ফ্লোরে শিশুদের একে অন্যের সঙ্গে কোনো সমস্যা হলে তা কর্তৃপক্ষ জানতে পারে না বা জানতে দেরি হয়। এ সময় আরও বড় বড় ঝামেলা হতে পারে বা মারামারি, প্রাচীর টপকে যাওয়াসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটতে পারে বলেও কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে।
জানতে চাইলে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক (সহকারী পরিচালক) মো. মঞ্জুরুল হাছান বলেন, এখানে অনুমোদিত জনবল ৪৯ জন হলেও বর্তমানে কর্মরত মাত্র ২৪ জন। অর্থাৎ ২৫টি পদ শূন্য রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, ওয়ার্ডার পদের ১৫টির মধ্যে ১৩টিই শূন্য। তাছাড়া দ্বিগুণের বেশি শিশুকে রাখতে হয়, আবাসন সংকটে একই ফ্লোরে বিভিন্ন বয়সের ও অপরাধের শিশুকে রাখতে হচ্ছে। এতে সমস্যা হয়।
মঞ্জুরুল হাছান আরও বলেন, ‘মাধ্যমিক স্তরের শিশুদের শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। কম্পিউটার, মোবাইল সার্ভিসিংসহ যুগোপযোগী কোনো প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা নেই। ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা হলে হাতগুলো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারত। আরও কিছু সমস্যা রয়েছে, এগুলো সংশ্লিষ্ট দফতরকে অবহিত করা হয়েছে।’
জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের উপপরিচালক অসিত কুমার সাহা বলেন, ‘শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা রয়েছে। জনবল সংকট এর মধ্যে অন্যতম। এটা না থাকলে সেবার মান বাড়নো সম্ভব হতো। বড় শিশুদের শিক্ষা বা আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় তাদের শুধু খেলাধুলার মধ্যে দিন কাটাতে হয়। স্বল্প টাকায় খাওয়ার ব্যবস্থা করার কারণে সেখানেও স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে এসব সমস্যা সমাধানে মন্ত্রণালয়ে বারবার যোগাযোগ করা হচ্ছে। আশা করা যায় দ্রুতই অনেক সমস্যা মিটে যাবে।
সারাবাংলা/এমও